রমজান মাসের বাড়তি ইবাদত, যেগুলো রাসুল (সা.)-ও আদায় করতেন

পবিত্র রমজান মাস আল্লাহ তাআলার মহান দান। সওয়াব ও পুণ্য লাভের অতুলনীয় মাস। মার্জনা ও মুক্তিপ্রাপ্তির সুবর্ণ সময়। রমজান মাস মানুষকে মহান হতে শেখায়, ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার প্রিয়ভাজন হতে, জান্নাত প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অর্জন করতে শেখায়।

নবী করিম (সা.) পবিত্র রমজানে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করে দিতেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তনু-মন উজাড় করে দিতেন। খাঁটি গোলাম হিসেবে ইবাদতের মাঝে নিজেকে মগ্ন রাখতেন।

ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করা আরো একটি ইবাদত। নবী করিম (সা.) রমজান মাসে যেসব ইবাদত বেশি করতেন, তার পূর্ণ বিবরণ কোরআন-হাদিসে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত আছে। তিনি নিজে এসব আমল করেছেন, উম্মতকে করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। রমজানে করণীয় প্রশ্নে উম্মতের সামনে অনুপম উপমা রেখে গেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে এমন ইবাদত করল— যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই; তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে।’কয়েকটি ইবাদত নিম্নরূপ:

    কোরআন পাঠ করা-কোরআন শেখা ও শেখানো

রাসুল (সা.) রমজান মাসে প্রচুর কোরআন পাঠ করতেন। সুযোগ পেলেই কোরআন পাঠে মশগুল হতেন। হজরত জিবরাইল (আ.) থেকে কোরআনের পাঠ গ্রহণ করতেন। তার সাথে কোরআন পাঠের প্রতিযোগিতা করতেন। হাদিসে আছে, ‘রমজানের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাত করতেন। কোরআন শুনিয়ে ও শুনে তারপর বিদায় গ্রহণ করতেন।’ (বোখারি, হাদিস: ১৯০২)

  • Save

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘পাঠকারীর পক্ষে কোরআন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। হে প্রভু! আমি তাকে রাতে ঘুমাতে দেইনি (রাতভর কোরআন পাঠ করেছে)। তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ কোরআনের অনুরোধ গ্রহণ করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৬৫৮৯)

     তারাবি-তাহাজ্জুদ আদায়

তারাবি নামাজ ইসলামি শরিয়তে সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তারাবি নামাজ আদায় করেছেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় তারাবি নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তাআলা তার পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন!’ (বোখারি, হাদিস: ২০০৯)

  • Save

নবী করিম (সা.) অন্যান্য সময়েও সাধারণত তাহাজ্জুদ নামাজ পরিত্যাগ করতেন না। কিন্তু রমজানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ নামাজ হলো তাহাজ্জুদ।’ (মুসলিম, হাদিস: ১১৬৩)

তাহাজ্জুদের বিশেষত্ব বোঝা যায় আয়েশা (রা)-এর একটি বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) রমজান মাসে দীর্ঘ রুকু-সেজদার মাধ্যমে, একনিষ্ঠ মনে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন।’ (বোখারি, হাদিস: ১১৪৭)

     দান-সদকা করা

  • Save

রমজান মাসে রাসুল (সা.) বিপুল পরিমাণ দান করতেন। দারিদ্রপীড়িত ও অভাবগ্রস্তদের খোঁজ-খবর নিতেন। পরিপোষক হয়ে পাশে দাঁড়াতেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) দানবীর ছিলেন। রমজান মাসেই তিনি বেশি বদান্যতার পরিচয় দিতেন। প্রবাহিত বাতাসের মতো অকুণ্ঠচিত্তে দান-সদকা ও কল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করতেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৩০৮)

     ইফতারি করানো ও খাদ্য সহায়তা

রমজানে নবী করিম (সা.)-এর একটি বিশেষ প্রিয় ইবাদত ছিল রোজাদারকে ইফতারি করানো, রোজাদারের খাবার সংস্থান করা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনও রোজাদারকে ইফতারি করাবে, সেও রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তবে রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও হ্রাস করা হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৮০৭)

  • Save

রাসুল (সা.) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-ও অন্যকে ইফতারি করানো, অভাবির খাদ্য সংস্থানের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। অনেক নফল ইবাদতের উপর এটাকে প্রাধান্য দিতেন। হজরত আলি (রা.)-এর বিখ্যাত উক্তি হলো, ‘বাজারে গিয়ে কোনও গোলাম ক্রয় করে আজাদ করার চেয়ে আমার নিকট বেশি সওয়াবের কাজ মনে হয়, খাবার সংগ্রহ করে ক্ষুধার্ত সাহাবিদের আহারের ব্যবস্থা করা।’ (মাজদি হিলাহি: ১/১৩)

ইতিকাফ পালন ও শবে কদর অনুসন্ধান

রমজানে ইতিকাফের প্রতি রাসুল (সা.) প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। এতো গুরুত্ব দিতেন যে, এক বছর সফরের কারণে ইতিকাফ করতে না পেরে পরের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৪৪৫) তেমনিভাবে শবে কদর পাওয়ার জন্য রাসুল (সা.) ব্যাকুল থাকতেন। চেষ্টা করতেন কোনোভাবেই যেন শবে কদরের ফজিলত থেকে বঞ্চিত না হন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকে নবী করিম (সা.) অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ইবাদত করতেন। শবে কদর পাওয়ার আশায় কোমর বেঁধে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ১১৭৪)

শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি রাত রয়েছে। এই রাত থেকে বঞ্চিত হলে সর্বপ্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। দুর্ভাগা ব্যতীত অন্য কেউ এই রাত থেকে বঞ্চিত হয় না।’ (নাসায়ি, হাদিস: ২১০৬)

     সেহরি-ইফতারি করা

রাসুল (সা.) সেহরি-ইফতারিকে খুব গুরুত্ব দিতেন। সেহরি-ইফতারির ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সেহরি গ্রহণকারীদের উপর মাগফিরাত ও রহমত বর্ষণ করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৬৫৪)

ইফতারির ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমরা দ্রুত ইফতারি করো, যতদিন দ্রুত ইফতারি করবে, ততদিন পর্যন্ত তোমাদের ভেতর কল্যাণ থাকবে।’ (বোখারি, হাদিস: ১৯৫৭)

     দোয়া ও তওবা করা

রমজান মাসকে রাসুল (সা.) কোঁচড় ভরে গ্রহণ করতেন। মিনতি করে মহান রবের সমীপে কান্নাকাটি-রোনাজারি করতেন। নবী করিম (সা.) রমজানে দোয়া কবুলের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮০৩০) অন্য হাদিসে আছে, ‘গুনাহ করার পর মানুষ তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৭৪৯)

  • Save

     সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে বিরত থাকা

রমজান মাস সওয়াব অর্জনের সেরা মৌসুম। আনুগত্য ও নেকি বৃদ্ধির মাস। নিজেকে সৌভাগ্যবান করে নেওয়ার মোক্ষম মুহূর্ত। এই মাসে পাপে লিপ্ত হওয়া চরম হতভাগ্যের নিদর্শন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে রোজা রেখে যে ব্যক্তি অন্যায়-অপরাধ করলো, পাপাচার পরিত্যাগ করলো না, পানাহার পরিত্যাগ করে আসলে তার কোনও লাভ হলো না!’ (বোখারি, হাদিস: ১৯০৩)

উপরের আলোচনা থেকে জানা গেলো—রাসুল (সা.) রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। রমজানে প্রত্যেক আমলে ৭০ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়ার কথা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং অন্যায়-অনর্থক কাজে সময় নষ্ট না করে, ক্ষমার মাসের মহামূল্যবান সময়গুলো ইবাদতে ব্যয় করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আল্লাহ তাআলা আমাদের তৌফিক দান করুন।