নারীজাগরণের অনন্য পথিকৃৎ হাজীবিবি

আরব দেশের লোক বিধায় লোকেরা তাঁকে হাজীবিবি বলে ডাকতেন। হাজীবিবি আরবী ও ফারসী ভাষা জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। নারী জাগরণে সর্বাগ্রে নারীদের শিক্ষিত করে তোলার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন। আজ থেকে প্রায় দুইশত বছর পূর্বে নারী শিক্ষার জন্য হাজীবিবি প্রতিষ্ঠা করেন একটি মহিলা মাদ্রাসা, বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে। হাজীবিবি এবং পরবর্তীতে তাঁর কন্যা জয়নব এবং নাতনি তহমিনা বেগম পর্যায়ক্রমে এই মাদ্রাসা পরিচালনা করেন।

হাজীবিবি; একজন আরবীয় মহিলা। আরব দেশের লোক বিধায় লোকেরা তাঁকে হাজীবিবি বলে ডাকতেন। তাঁর প্রকৃত নাম জানা নেই। হাজীবিবি হলেন মোল্লা আলরুমের স্ত্রী ও হাজী শহরুল্লাহ’র মাতা। মোল্লা আলরুম পারস্যের বিখ্যাত মোল্লা জিয়নের পৌত্র এবং তাঁরা ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদি:)এঁর বংশধর। হাজী শহরুল্লাহ’র পিতামহ, মোল্লা আলরুমের পিতা মোল্লা কাশেম বাংলায় আসেন। তিনি মোয়াল্লেমের কাজ করতেন। দেশ বিদেশ ঘুরে হাজীদের নিয়ে হজ্জ করাতেন। বাংলায় এসে তৎকালীন পাবনা জেলার ইউসুফশাহী অঞ্চলে তালুক কিনে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমান তা সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর।

বর্তমান যমুনা নদী, যা পূর্বকালে যনাই নামে ব্রহ্মপুত্রের একটি ক্ষীণ শাখা নদী হিসেবে প্রবাহিত ছিল। ব্রহ্মপুত্রের মূল স্রোতধারা তখন মধুপুর গড়ের পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত হত। সেই যনাই নদীর তীরবর্তী,যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অজপাড়া এনায়েতপুর গ্রাম। যে গ্রামের নামকরণ করে গোড়াপত্তন করেছিলেন বাংলা ভারতের অবিসংবাদিত ইসলাম প্রচারক খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলী এনায়েতপুরীর (রহ:)ষষ্ঠ পূর্বপুরুষ শাহ্‌ জমির। উনার পিতা শায়খ শাহ্‌ ইসমাইল ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মোঘল আমলে ভারতবর্ষে আগমন করেন। দিল্লীর সুলতান উনাদের বরণ করেন এবং ধর্মীয় আমীর (মীর-ই-বাংলা)করেন। সে সময় তাঁরা মুর্শিদাবাদে বসবাস করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ইংরেজদের সাথে নবাবদের বিরোধের কালক্রমে মুর্শিদাবাদ ইংরেজ কবলিত হলে এ বংশীয়রা মীরজাফরের কোপানলে পতিত হন এবং মুর্শিদাবাদ ছেড়ে নদীপথে গঙ্গা পূর্বপাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নেন। মুর্শিদাবাদ হতে পরিবারসহ শাহ্‌ জমির প্রথমে পাবনার আমিনপুরের মীরদের কাছে আশ্রয় নেন। পরে লোকালয় ছেড়ে যনাই নদীর তীরবর্তী জঙ্গলে ঘেরা নিভৃত বনভূমিতে এসে উপস্থিত হন। বনভূমি পরিষ্কার করে ঘর-মসজিদ-রাস্তা নির্মাণ করেন। এলাকার নামকরণ করেন এনায়েতপুর; এনায়েত অর্থ আল্লাহর দানকৃত;পুর অর্থ এলাকা বা অঞ্চল। উল্লেখ্য যে, ব্রহ্মপুত্র নদীর গতি পরিবর্তন এবং যমুনা নদীর উৎপত্তির ফলে এলাকাটি মোমেনশাহী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৮৫৫ সনে এই অঞ্চলকে পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

হাজীবিবি আরবী ও ফারসী ভাষা জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। এই নিভৃত পল্লী এনায়েতপুরেই তালুক কিনেন হাজী শহরুল্লাহ’র পিতা ও হাজীবিবি’র শ্বশুর মোল্লা কাশেম। যনাই নদীর তীরবর্তী ঘন জঙ্গলে ঘেরা নিভৃত পল্লীতে নারীদের অবস্থা ও পরিস্থিতি অবলোকনে বিষণ্ণ হয়ে উঠে হাজীবিবির হৃদয় মন। সিদ্ধান্ত নেন, নারীদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু করবেন। ঘরের মেয়েরা সচেতন হলে, তাদের জীবনমান উন্নত হলে স্বাভাবিক ভাবেই সংসারের সকলের মানোন্নয়ন সহজতর হবে। তাই নারী জাগরণে সর্বাগ্রে নারীদের শিক্ষিত করে তোলার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন। আজ থেকে প্রায় দুইশত বছর পূর্বে নারী শিক্ষার জন্য হাজীবিবি প্রতিষ্ঠা করেন একটি মহিলা মাদ্রাসা, বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে। যা তখন নিভৃত পল্লী, নদী ঘেরা বনভূমি ছিল।

হাজীবিবি এবং পরবর্তীতে তাঁর কন্যা জয়নব এবং নাতনি তহমিনা বেগম পর্যায়ক্রমে এই মাদ্রাসা পরিচালনা করেন। এনায়েতপুর এবং আশেপাশে নারীদের মধ্যে যে ইসলামী শিক্ষার প্রচলন দেখা যায়, তা এই মহিলাত্রয়ের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফসল। হাজী শহরুল্লাহ’র কন্যা তাহমিনা বেগম ছিলেন বাংলা ভারতের অবিসংবাদিত ইসলাম প্রচারক খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলী এনায়েতপুরীর (রহ:) মাতা। তাহমিনা বেগম কুরআনের হাফেজা ছিলেন এবং আরবী ও ফারসী ভাষায় উচ্চ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। খাজা হুজুর মায়ের তত্ত্বাবধানেই অতি অল্প বয়সে কুরআন খতম করেন এবং আরবী ও ফারসী ভাষা লিখতে, পড়তে এবং বলতে শিখেন।

হাজী শহরুল্লাহ বিশ্ব পর্যটন করেছিলেন বলে লোকে তাকে মোল্লা ফিরোজ বলতো। যৌবনকালে তিনি দুইবার পায়ে হেটে হজ্জ করেন। হজব্রত পালন করে মক্কায় মাতুলালয়ে কিছুকাল অবস্থান করেন। মাতৃবংশের স্বজনরা হাজী শহরুল্লাহ’র বিবাহ দেন। ৭/৮ বৎসর সংসার করার পর তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করলে তিনি মক্কা হতে বাগদাদ গিয়ে কাদেরিয়া খানকার গদিনশীন পীর হযরত সৈয়দ আহমদের মুরিদ হয়ে ছয় বৎসরকাল তথায় অবস্থান করে কাদেরিয়া তরিকার ছুলুক শিক্ষা করে কামেলিয়াত লাভ করেন। হাজী শহরুল্লাহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে দেখেন কিছুদিন আগেই তাঁর পিতা দুনিয়ার সফর শেষ করেছেন। একদিকে পিতা হারানোর শোক, তার সাথে ইংরেজদের অত্যাচারে এলাকাবাসীর অবস্থা নাজেহাল। মহীয়সী মাতা হাজীবিবির পরামর্শে জনসচেতনতা, শিক্ষাদান ও অধিকার আদায়ের লক্ষে সংস্কার আন্দোলন তথা শরা আন্দোলন শুরু করেন হাজী শহরুল্লাহ। নারী জাগরণ এবং গণজাগরণ শুরু করেন মা-পুত্র মিলে।

হাজী শহরুল্লাহ’র গৃহে ১২৯৩ সালের ২১শে কার্তিক, তদানিন্তন বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার এনায়েতপুর গ্রামে পুণ্যবতী তাহমিনা বেগম (রহ:)এর কোল আলোকিত করে শুভাগমন করেন হযরত মাওলানা শাহ খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রহ:)। তাঁর পিতা মৌলানা শাহ্‌ আবদুল করিম (জন্ম ১৮৫৪) ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিক্ষক এবং বিশিষ্ট আলেম। তিনি হুগলী মোহছানিয়া মাদ্রাসা হতে সর্বোচ্চ নেছাব পাশ করেন। হুগলী মাদ্রাসায় কিছুদিন অধ্যাপনার কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। দেশে ফিরে শাহ্‌ আবদুল করিম পৈত্রিক মাদ্রাসার সংস্কার সাধন করেন এবং সরকার হতে মজুরী প্রাপ্ত হন। খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলীও সেই সময়েই ইংরেজী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্দি করে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সাথে পৈত্রিক দাখিল মাদ্রাসা তো ছিলই। শুধু দ্বীন ধর্মের নয় বরং জনসেবা, মানুষের কল্যাণে কাজ করা তাঁদের বংশীয় ধারায় মিশ্রিত। নিভৃত পল্লী হওয়ায় চিকিৎসা সেবা ছিলোনা বললেই চলে। খাজা সাহেব চালু করলেন দাতব্য চিকিৎসালয়। আজও তা চলমান আছে। খাজা শাহ্ এনায়েতপুরী (রহ:) ছাহেব দ্বীন ও তরিকার খেদমতের পাশাপাশি মানবতা ও সৃষ্টির সেবার অনবদ্য নজির রেখে গেছেন। তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর ভক্ত অনুরাগীদের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এশিয়া বিখ্যাত খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল, খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ, খাজা ইউনুছ আলী নার্সিং কলেজ, খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট, খাজা ইউনুছ আলী ল্যাবরেটরী স্কুল এ্যান্ড কলেজ, খাজা ইউনুছ আলী ক্যান্সার সেন্টার তাঁর নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফের বর্তমান দায়রা শরীফের উত্তর দিকে যে লম্বা ঘরটি রয়েছে (হুজরা ঘর) তা ছিল এ অঞ্চলের আদি মাদ্রাসা। এটি খাজা সাহেবের পূর্বপুরুষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  এ স্থানে তিনারা একটি মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন। যা বর্তমানে দায়রা শরীফ ও বড় মসজিদের একাংশে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে পূর্বকালে মোহররমের নেয়াজ বিতরণ করা হত। বর্তমান দায়রা সংলগ্ন কবরস্থানে খাজা সাহেবের পূর্বপুরুষ হযরত শাহ বাহারুল্লাহ, হযরত শাহ কবির এবং হযরত মৌলানা আবদুল করিমের কবর রয়েছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলী’র (রহ:) মাতৃকুল ও পিতৃকুল এতদঞ্চলে ধর্মীয় জাগরণ, শিক্ষা জাগরণ, অধিকার সচেতনতা, নারী জাগরণসহ সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণে এবং কল্যাণময় আখিরাত গঠনের পথিকৃৎ।