গ্রাম বাংলার মোনমুগ্ধকর দৃশ্য সবার মন ছুঁয়ে যায় এটাতো প্রত্যেক গ্রামেরই উৎস। গ্রাম মানেই তো আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, ধানখেতে সবুজের সমারোহ, শীতকালে খেজুরের রসে ভরা হারি খেজুর গাছে ঝুলে থাকা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোলাহল। এটা তো এখন স্বাভাবিক বিষয়। তাহলে নতুনত্ব কি আছে এই হুলহুলিয়া গ্রামে। এই পুরো গল্পটা পরলে আপনার সব কৌতুহল কেটে যাবে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত বিস্ময়কর গ্রাম হুলহুলিয়া। জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলনবিলবেষ্টিত গ্রামটির আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের শুধু নয়, গ্রাম পরিচালনার ভিন্ন নিয়মকানুন ও বিচক্ষনতার জন্য মধ্যে এখানকার মানুষগুলোও হয়ে উঠেছেন সুন্দর। এ সুন্দর যতটা না চোখে দেখার, তার চেয়ে বেশি অনুভবের। গত ৫০ বছরে কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য কখনো এই গ্রামে পুলিশ আসেনি । এখানে কোন রাজনৈতিক বিভাজন, হানাহানি নেই। শুধু তা-ই নয়, গ্রামের মানুষজনও শতভাগ শিক্ষিত। এছাড়াও গ্রামটি বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুকমুক্ত। সুখে-দুঃখে একে-অন্যের পাশে থাকেন সবাই।
গ্রামে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল একটি গেট। যেখানে লেখা রয়েছে, ‘আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া’। এখানে শিক্ষার পাশাপাশি স্যানিটেশন-ব্যবস্থাও প্রায় শতভাগ। শীতে এ গ্রামে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে। কিন্তু গ্রামের কারোরই পাখি মারার স্বভাব নেই। গ্রামটি থেকে দুই শর বেশি বিএসসি প্রকৌশলী, শতাধিক এমবিবিএস চিকিৎসক, ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। আদর্শ গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ।
পরিষদের সহসভাপতি মো. আলমগীর কবীর শাহ জানান, শত বছর আগে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যায়। গ্রামের ঘরে ঘরে তখন অভাব, মনে কষ্ট আর হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের লোকদের নিয়ে সভা ডাকেন তিনি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, যাঁদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তাঁরা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, সোনার ফসলে ভরে ওঠে জমি। সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ গঠন করে গ্রামবাসী।
আলমগীর জানান, এ পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’ পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের পরিষদে আছেন পাঁচজন উপদেষ্টাও। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটেই সদস্যরা নির্বাচিত হন। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই পরিষদই আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করে দেয়। বড় অপরাধ নেই, তাই দরকার হয়নি থানায় যাওয়ারও।
১৯৬৬ সালের কথা। হুলহুলিয়াতে তখন প্রথম উচ্চবিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। গ্রামের দরিদ্র মানুষদের কথা ভেবে শিক্ষকদের অনেকেই বিনা বেতনে শিক্ষাদান করেন। এরপর হয় মাদ্রাসাও। বর্তমানে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি দুটি বিদ্যালয়ও চলছে।
১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। যেটির কাজ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামের রয়েছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের সংগঠন। ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি স্থায়ী কবরস্থান রয়েছে গ্রামে।
সিংড়া থানার ওসি নুর-এ-আলম সিদ্দিকী বলেন, হুলহুলিয়া গ্রামের মানুষ মিলেমিশে থাকে। কোনো মামলা আছে বলে আমার জানা নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম সামিরুল ইসলাম বলেন, হুলহুলিয়া একটা আদর্শ গ্রাম। এটি সিংড়া উপজেলার গর্ব।