পতিতাবৃত্তি দিয়ে ক্ষমতা ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে পাপিয়ার সাতকাহন

কালের সব থেকে বড় ধামাকা দেখালো একজন সাধারণ গাড়িচালকের মেয়ে পাপিয়া ওরফে পিউ। মক্ষীরানি, অস্ত্র কারবারি, চাঁদাবাজি, নেশাসহ সকল কিছু এক গ্লাসে ঢেলে তৈরি করেছে অপরাধের ককটেল- যা দিয়ে বশ করেছে রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের। সেই কবজ দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করেছে ক্ষমতার ছড়ি। ক্যাসিনো কাণ্ডের চেয়েও বেশি ঝড় তুলেছে পাপিয়ার পতিতাবৃত্তি ও অপরাধ জগতের গল্প। মুখে মুখে আলোচনা- একজন সাধারণ গাড়িচালকের মেয়ে কীভাবে এই সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন! শুধুমাত্র পতিতাবৃত্তি দিয়ে কীভাবে তিনি সরকারি দলের রাজনীতি ও সরকারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন! কারাইবা মদদ দিয়েছে তাকে। এই  অপরাধ জগতের সুবিধাভোগী কারা, এনিয়েও আলোচনা চারপাশে। শুধুমাত্র পাপিয়া নয় এই অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন। তাদের সহযোগিতা না থাকলে এই ধরনের অপরাধ করা সম্ভব ছিল না। র‍্যাবের হাতে পাকড়াও হওয়ার পর  পাপিয়ার অন্ধকার জগতের নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে, খোঁজা হচ্ছে তার মদদদাতাদের। দীর্ঘদিন ধরে দেহব্যবসা, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ইতোমধ্যে তিন মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাকে। নরসিংদীতে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স প্রদান, গ্যাসলাইন সংযোগ দেয়ার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন। পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার নামেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন পাপিয়া-সুমন দম্পতি। সুনির্দিষ্ট পেশা না থাকা সত্ত্বেও তারা স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোয় মাঝেমধ্যেই ‘ককটেল পার্টি’র আয়োজন করতেন। এসব পার্টিতে উপস্থিত হতেন সমাজের উচ্চস্তরের লোকজন। মদের পাশাপাশি পার্টিতে উপস্থিত থাকত উঠতি বয়সী সুন্দরী তরুণীরা। গ্রেফতারের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় বাইজি সর্দারনী বেশে পাপিয়ার অশ্লীল ভিডিও। ইতিমধ্যে তার অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কথা বের হতে শুরু করছে। মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, পতিতা ব্যবসার পাশাপাশি ব্ল্যাকমেইল করে পাপিয়া ও তার স্বামী গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অপরাধে জড়িয়ে পড়া পাপিয়াকে ইতোমধ্যে সংগঠন- যুব মহিলা লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, পাপিয়ার পাপের শাস্তি তাকে বহিষ্কারের মধ্যেই সীমিত থাকবে না। তার বিচার রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়, হবে অপরাধ বিবেচনায়।
কে এই  পাপিয়া: শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। অটো গ্যারেজের মালিক সাইফুল বারীর মেয়ে এই পাপিয়া। এর আগে সাইফুল বারী পেট্রোবাংলার গাড়িচালক ছিলেন। অন্যদিকে, তার স্বামী মতি সুমনের বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী একজন গানের শিক্ষক। আধাপাকা টিনশেড ঘরেই কেটেছে তাদের দুজনের শৈশব-যৌবন। ছোটবেলা থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুমন। ২০০৯ সালে প্রেমের সম্পর্কের পর পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করেন সুমন। এরপর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন পাপিয়া। এই দম্পতির মাদহাত চৌধুরী ইসাব নামে আট বছরের একটি ছেলে রয়েছে। তবে গত পাঁচ বছরে অর্থ বিত্তে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তারা। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বনেছেন শত কোটি টাকার মালিক। দেশে গাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি বিদেশে দিয়েছেন বার। আর সবই করেছেন, অন্যায় ও অপকর্মের ওপর ভর করে। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও দেহ ব্যবসাই তাদের মূল পেশা। অতি সস্প্রতি পাপিয়া দোতলা আধুনিক একটি বাড়ি করেছেন। ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহব্বায়ক মতি সুমনের উত্থান। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর তিনি আলোচনায় আসেন। ২০১২ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় নিজ বাসার সামনে সুমনের ওপর গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিটি বিদ্ধ হয় তার স্ত্রী পাপিয়ার পেটে। এরপর তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ওই নেত্রীর মাধ্যমেই বাড়তে থাকে তার বলয়। প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে গড়ে তোলেন এক বিশাল সিন্ডিকেট।

ক্ষমতাসীনদের মধ্যে অস্বস্তি: পাপিয়াকে নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী যুব মহিলা লীগ বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছে। বিশেষ করে পাপিয়ার সঙ্গে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের গুরত্বপূর্ণ নেতা এবং মন্ত্রীদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার পর এটি তাদের মধ্যে বিরাট অস্বস্তি তৈরি করে। কেউ কেউ আতংকেও আছেন, অপকর্মের ভিডিও প্রকাশ হয়ে যায় কিনা, এ নিয়ে। সাবেক মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, পাপিয়া কেলেংকারিতে লজ্জায় মুখ দেখানো যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে অব্যাহত সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত সোমবার মন্তব্য করেন যে, এ ধরণের কাজের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্সের নীতি নিয়েছে বলেই এই অভিযান চালানো হয়েছে।                                                পাপিয়ার যত কুকর্ম, প্রতারণার অভিনব কৌশল: নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এবার আলোচনায় এসেছে তার ধর্ম পালন নিয়ে। এক র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, পাপিয়া শিবলিঙ্গের পূজা করতেন, কালী পূজা করতেন নিয়মিত। কাবা শরিফের লোগোও নিজের কাছে রাখতেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর (রহ) নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে নিজেদের দেহে ট্যাটুও করিয়েছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, অবৈধভাবে অর্থ আয়ের জন্য প্রতিটি ধর্মের লোকদের বিশ্বাস স্থাপন করতে এটা তার কৌশল। এমনটাই জানিয়েছেন ওই র‌্যাব কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, পাঁচ তারকা হোটেলের বিশালবহুল কক্ষ থেকে শুরু গাড়ি বাড়ি কোনো কিছুর অভাব ছিলো না তার। খরচ করতেন কোটি কোটি টাকা। হোটেল বয়দের টিপস দিতেন ১০-১২ হাজার টাকা। সবই করতেন নগদে। তবে এসব টাকার উৎস পায়নি র‌্যাব। তাদের ধারণা মাদক-অস্ত্র চোরাচালান, জমি দখল করিয়ে দেয়া, হোটেলে নারীদের দিয়ে যৌন বাণিজ্য থেকে  মোটা অঙ্কের অর্থ আসত পাপিয়ার হাতে।
হোটেল ওয়েস্টিনেই ৩ মাসে ৩ কোটি টাকা বিল দিয়েছে পাপিয়া। পাপিয়ার যেন পাপের শেষ নেই। আলোচনায় উঠে এসেছে তার হোটেলের বিলের হিসাব। র‌্যাবের তথ্যমতে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের কয়েকটি কক্ষ গত নভেম্বরে ভাড়া নেন পাপিয়া। তিনি গত তিন মাসে ওই কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। ১৯ তলায় একটি বার রয়েছে, যেটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিতেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল পরিশোধ করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যায়, গত তিন মাসে তিনি প্রায় তিন কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছেন হোটেল কর্তৃপক্ষকে।
রুশ তরুণী দিয়ে ভিআইপিদের ব্লাকমেইল:
ভিআইপিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে ১২ রুশ তরুণীকে ব্যবহার করতেন পাপিয়া। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিন তিনি এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ ক্যামেরা দিয়ে ভিআইপিদের অনৈতিক কর্মকান্ডের ভিডিও চিত্র ধারণ করে রাখা হত। পরবর্তী সময়ে সেই ফুটেজ ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হত মোটা অংকের টাকা। এসব কাজে স্বামী সুমন চৌধুরী পাপিয়াকে সহায়তা করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম বলেছেন, যাদের সঙ্গে তার ‘বিশেষ সম্পর্ক’  রয়েছে। মূলত এসব নেতাই পাপিয়ার উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন এমপির সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়েও মুখ খুলেছেন পাপিয়া।
পাপিয়ার যৌন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম ‘এসকর্ট’ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে: বাংলাদেশে প্রথম অনলাইনভিত্তিক যৌন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম ‘এসকর্ট’ গড়ে তোলেন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। এটি গড়ে তুলতে রাজনীতিকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করা হত। কয়েক বছর আগে ‘এসকর্ট’টি গড়ে তোলা হলেও এরই মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সারাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোয়। এই ব্যবসা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনও সক্রিয় রয়েছে। রিমান্ডের প্রথম দিনেই জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন পাপিয়া। এসকর্টের সঙ্গে জড়িত দেহব্যবসায়ী সুন্দরী তরুণী এবং তাদের খদ্দেরদের নামও বলেছে পাপিয়া। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, রাজনীতির নারীদের নিয়ে ‘বাণিজ্য’ করতেন পাপিয়া। রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোয় মাঝেমধ্যেই ‘ককটেল পার্টি’র আয়োজন করতেন। এসব পার্টিতে উপস্থিত হতেন সমাজের উচ্চস্তরের লোকজন। মদের পাশাপাশি পার্টিতে উপস্থিত থাকত এসকর্ট গ্রুপের উঠতি বয়সী সুন্দরী তরুণীরা। মদের নেশায় টালমাটাল আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কৌশলে ধারণ করা হতো ওই তরুণীদের অশ্লীল ভিডিও। পরে ওইসব ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করতেন পাপিয়া। বনিবনা না হলে তা ফেসবুকে ছড়িয়েও দেয়া হতো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই পাপিয়ার কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক মাথা ঘুরিয়ে দেয়া খবর। পাপিয়ার অপকর্মের সঙ্গীদের ধরতে এরই মধ্যে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। র‌্যবের ওই কর্মকর্তা বলেন, পাপিয়ার মূল ব্যবসা ছিল উঠতি শিল্পপতি-ব্যবসায়ীসহ সমাজের উঁচুস্তরের লোকদের ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়। আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেছেন, নরসিংদী ও ঢাকার অনেক তরুণীকে চাকরির নামে তারকা হোটেলে ডেকে পার্টি গার্ল হিসেবে ব্যবহার করা হত। তাদের করা হত এসকর্টের সদস্য। এসকর্টের সুন্দরীদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে বিত্তবানদের শয্যাসঙ্গী করতে বাধ্য করতেন পাপিয়া। এসব কুকর্মের বেশকিছু ভিডিও এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পাপিয়ার অর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। দুদক পাপিয়া-মফিজুর রহমান সুমন দম্পতির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ নিতে রাজস্ব বোর্ডকে খুব শিগগিরই চিঠি দেবে বলে জানা গেছে। এই দম্পতির ব্যাংক হিসাব জব্দের জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেবে দুদক। দুদক বলছে, পাপিয়া থেকে সুবিধা নেয়া রাজনৈতিক দলের নেতাদের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তালিকা পাওয়ার পর তাদেরও নজরদারির আওতায় আনা হবে।
যেভাবে গড়ে তুলেছে অবৈধ সম্পদের পাহাড়: অল্প সময়ের মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন পাপিয়া। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোতে সুন্দরী তরুণী সরবরাহ, মাদক চোরাচালান, চাকরির তদবির, জবর-দখল, দেশ বিদেশে ক্যাসিনো ব্যবসা- এমন কোনো অভিযোগ নেই যা তার বিরুদ্ধে নেই। সুন্দর অবয়বের আড়ালে পাপিয়ার পাপের সাম্রাজ্য এতদিন আড়ালেই ছিল। অবশেষে দেশবাসীর কাছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নরসিংদী জেলা শহরে বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় দুইতলা বিশিষ্ট বাড়ি রয়েছে। অতি সম্প্রতি পৌর শহরের ব্রাহ্মন্দী এলাকায় তার স্বামী মতি সুমন বিলাসবহুল ৬তলা বাড়ি করেছেন। বিলাদী মোড়ে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ এবং আরেকটি ৬ শতাংশের মূল্যবান দুটি প্লট রয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মন্দীতে স্বামীর দোতলা একটি বাড়ি আছে। রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’ বিলাসবহুল ভবনে তার ও তার স্বামীর নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া তার কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়া ও একটি ভিজেল কার আছে। নরসিংদী শহরে পাঁচটি মোটরসাইকেল রয়েছে। মোটরসাইকেলগুলো তার অনুসারীরা তাকে প্রটোকল দেয়ার কাজে ব্যবহার করে। নরসিংদী শহরে সুমন চৌধুরীর কেএমসি কার ওয়াশ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। কার ওয়াশ ব্যবসার আড়ালে এখানে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলে। পাপিয়ার স্বামীর মালিকানায় থাইল্যান্ডে একটি বারও আছে।
পাপিয়ার সিটি ব্যাংকের একটি এমেক্স গোল্ড ক্রেডিট কার্ড ও একটি এমেক্স গ্রিন ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। রাজধানীর এফডিসি গেটের সঙ্গে ‘কার এক্সচেঞ্জ’ নামে তার একটি গাড়ির শোরুম আছে। নরসিংদীর শালিদা এলাকায় আরএসএম কার ওয়াশ নামে একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, ব্লাকমেইলই তাদের প্রধান পেশা। তারা প্রথমে সুন্দরী নারীদের পাঠায়। তারপর কৌশলে ধনী ব্যক্তিদের ভিডিও করে। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়।
শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শ্যামল কুমার সাহা বলেন, এত অল্প সময়ে কেউ বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হতে পারে না। তারা অনৈতিক কাজ করেই এ সব অর্জন করেছে। অসহায় ও দরিদ্র মেয়েদের চাকরি দেয়ার কথা বলে তাদের দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য করত। নইলে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। নরসিংদী শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামীর চালচলন দেখে প্রথম থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিল। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সন্দেহের বাইরে ছিল না। তার আয়ের উৎস সম্পর্কে সব সময় ধোঁয়াশা ছিল। জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসিবুল ইসলাম মিন্টু বলেন, পাপিয়া ও সুমনের সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাদের সঙ্গে কারো ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে পারে। এ ব্যাপারে আমার ধারণা নেই।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন পাপিয়াসুমন দম্পতি: র‍্যাব গত ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া-দম্পতিসহ চারজনকে অবৈধ অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮), সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২)। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, নগদ দুই লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। গ্রেফতারের পর পাপিয়ার মোবাইল ফোন তদন্ত করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। তার ফোনটি অশ্লীল ভিডিওতে ঠাসা। এসব ভিডিওতে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে উঠতি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ছাড়াও আমলা এবং কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার অশ্লীল ছবি রয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানান তথ্য। পাওয়া যাচ্ছে পাপিয়া দম্পতির সম্পদের হিসেব। ঢাকা ও নরসিংদীতে ফ্ল্যাট-প্লট, গাড়ি ও ব্যবসা ছাড়াও দেশে-বিদেশে ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার কথা জানা গেছে। (সুত্রঃ সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ)