জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়নি। বরং মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ঘটনা ফলাও করে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা অনন্য নজির হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। জাতিসংঘের মতো সংস্থায় বাংলাদেশের এমন অবস্থান আশাজাগানিয়া বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনটি আমাদের মানবাধিকারকে আরও সমন্বিত করার ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে রাখবে। সাধারণত ‘দেশ ভালো চলছে না, দেশ ভালো নেই, মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নেই,’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন বক্তব্য ও প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বহির্বিশ্বে চাপ তৈরির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যারা নালিশ করেন, তারা ব্যক্তি, রাজনৈতিক নাকি দেশের স্বার্থে তা করেন। জাতিসংঘও তখন ব্যবস্থাগুলো সেভাবে গ্রহণ করে।’
বিদেশে অভিযোগ দেয়ার আগে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও তা মাথায় রাখতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তৌহিদুল হক আরও বলেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিনষ্ট কিংবা হেয় করে উপস্থাপন করার মধ্যে রাজনৈতিক অপতৎপরতা জড়িত রয়েছে।
যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ বিএনপির নেতারা। সময় সংবাদকে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, মিশেল ব্যাচেলেট ইচ্ছা করে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এড়িয়ে গেছেন। তার মতে, বাংলাদেশে মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। বাংলাদেশে গুম-খুন অহরহ চলছে। বিচারহীনতা রয়েছে, দুঃশাসন রয়েছে।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এখানে সফরের সময় সব বলে গেছেন মিশেল ব্যাচেলেট। কাজেই জাতিসংঘের প্রতিবেদনে নতুন করে তা তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেননি। অন্য দেশগুলো নিয়ে সার্বিক একটি বিবৃতি দিয়েছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ কিংবা জাতিসংঘ কী চায়, তা তিনি বাংলাদেশ সফরেই স্পষ্ট করে গেছেন। যে কারণে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে তার পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। তিনি জানান, এতে সরকারের সুখানুভূতির কোনো কারণ নেই। সরকার কিংবা তার অনুগতদের খুশি হওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
মিশেল ব্যাচেলেটের সর্বশেষ প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলতে চাইলে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। তিনি জানান, এ প্রতিবেদন নিয়ে আমার কথা বলার কিছু নেই। কারণ এটি জাতিসংঘের প্রতিবেদন, এ নিয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ১৫ আগস্টের বৈঠক নিয়ে জানান, আমরা চ্যাটাম হাউস রুল অনুসারে কথা বলেছি। এ নিয়ে বাইরে কথা বলা যাবে না।
সময় সংবাদকে খুশি কবির বলেন, ‘আমরা যা বলেছি, তার সবকিছুই যে তারা গ্রহণ করেছেন তাও না। তাদের (মিশেল ব্যাচেলেট) নিজেদের টিম আগে কিছু ব্যক্তিদের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, আর এখানকার কার্যালয়ের কাছে যে প্রতিবেদনগুলো আছে, পত্রিকার খবরগুলো- সবকিছু বিবেচনা করে তিনি নিজের বক্তব্যটা দিয়েছেন ‘
এ মানবাধিকারকর্মী জানান, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও জনগণের মানবতা ছিল আমার কথা বলার পয়েন্ট। নিজের প্রতিবেদন তিনি নিজের মতো করেই করবেন। তারাই আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমাদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছেন। এখন তিনি কোন বক্তব্য গ্রহণ করবেন কিংবা করবেন না, কেন গ্রহণ করেছেন বা করেননি- তা একান্তই তার ব্যাপার। আমাদের ডেকেছেন, বক্তব্য শুনতে চেয়েছেন, আমরা কথা বলেছি।
বাংলাদেশ সফরকারী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ প্রকাশিত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
১৫ আগস্ট মিশেল ব্যাচেলেটের সঙ্গে বৈঠকে আরও অনেকের সঙ্গে অংশ নেন আইনজীবী সারা হোসেন। যিনি ডেভিড বার্গম্যানের স্ত্রী ও সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের মেয়ে। বৈঠকের পর তিনি বলেন, ‘এখানে যারা আমরা বাংলাদেশি মানবাধিকার বা আইন সহায়তা নিয়ে কাজ করছি, আমাদের কথাগুলো আমরা তুলে ধরেছি।’
সফরের শেষ দিন সাংবাদিকদের মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, এখানে কারও বক্তব্যে তিনি সন্তুষ্ট হতে আসেননি। তবে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন।
গেল ১৮ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মিশেল ব্যাচেলেট ও তার প্রতিনিধি দল মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিভিন্ন সময়ে বিএনপির প্রতিবেদনেরই প্রতিচ্ছবি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে আগামী বুধবার (৩১ আগস্ট) তার মেয়াদ শেষ হবে। সে হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সর্বশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলেন বৃহস্পতিবার। তার মেয়াদকালে বিশ্বজুড়ে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে বলে দাবি করেন তিনি।
করোনা মহামারির গভীরতর আঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটের উপর্যুপরি অভিঘাত- এ তিনটি বড় সংকটের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, দেশগুলোতে মেরুকরণ অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। আর কঠিন চাপের মধ্যে আছে বহুত্ববাদ। কাঠামোগত বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অগ্রাহ্য করা, দুর্নীতি, সুশাসনের ঘাটতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দেশে দেশে প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা, হুমকি, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার ঘটনাও রয়েছে। তার মতে, এতে কোনো কোনো দেশে বড় পরিবর্তন আসলেও কোথাও সরকারের পদক্ষেপে মতভিন্নতা ও বিতর্কের জায়গা ছোট হয়ে এসেছে।
চিলির দুবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পথে থাকলে গেল কয়েক মাসে বুরকিনা ফাসো, নাইজার, আফগানিস্তান, চীন, বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা, পেরু ও বাংলাদেশ সফর করেছি। এতে জলবায়ু পরিবর্তন, সশস্ত্র সংঘাত, খাদ্য-জ্বালানি-অর্থনৈতিক সংকট, ঘৃণাবাদী বক্তব্য, পরিকল্পিত বৈষম্য ও অভিবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মানবাধিকারের প্রতিকূলতাগুলো সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে।
মানবাধিকারের সম্প্রসারণ এবং সুরক্ষা দিতে সহায়তা, পর্যবেক্ষণ ও প্রচারে বহুভাবে কাজ করছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়। তিনি জানান, জাতিসংঘে আগেও আমি বলেছি যে সংলাপ, সহযোগিতা, অন্তর্ভুক্তি, পর্যবেক্ষণ, প্রচার ও প্রতিবেদন আমাদের ডিএনএ’র সর্বাংশ হওয়া উচিত। সরকার ও সুশীল সমাজের মধ্যে দূরত্ব দূর করতেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, মানবাধিকারের সব বাধ্যবাধকতার বাস্তবায়ন, আইন ও নীতিগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সংস্কার এবং দেশগুলোর মধ্যে আমাদের উপস্থিতি সম্প্রসারণে সক্রিয় রয়েছি। কাজেই তৃণমূল পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার মধ্যদিয়ে আমরা ভালো অবস্থানে আছি। কোনো সুনির্দিষ্ট দেশ কিংবা আরও বিস্তৃত পর্যায়ে ব্যক্তিগত কিংবা প্রকাশ্যে আমাদের সরব থাকতে হবে। সবমিলিয়ে কিছু অগ্রগতি আমাদের চোখে পড়ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল কয়েক মাসে চরম আবহাওয়া বলে দিচ্ছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। চলতি সময়ের মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই চাহিদা পূরণ করা। এ ক্ষেত্রে সব দেশেরই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদের আলোচনায় বসতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি- এই তিন সংকট নিরসনে পদক্ষেপ মানবাধিকারকেন্দ্রীক হতে হবে। তথ্য ও ন্যায়বিচার পাওয়া ও তাতে অংশগ্রহণের অধিকার সুগম করতে হবে। প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিতদের ওপর পরিবেশগত ক্ষতির অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব নিরসন করতে হবে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিল করতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা বাতিল কিংবা আপাতত স্থগিত অথবা ১০ বছরেরও বেশি সময় রায় কার্যকর স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রায় ১৭০টি দেশ। যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছে, তাদের মধ্যে আছে আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, চাদ, কাজাখস্তান, সিয়েরা লিওন ও পাপুয়া নিউগিনি। লাইবেরিয়ো ও জাম্বিয়াও সর্বোচ্চ সাজা রদ করার কথা সক্রিয়ভাবে ভাবছে।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিল করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া। এছাড়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিলে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করেছে ৯০টি দেশ। কিন্তু এরপরও ইরান, সৌদি আরব, মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বৃদ্ধি কিংবা নতুন করে শুরু করা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ও অনুসন্ধানের সুযোগ সীমিত করে দিতে উপাত্ত শ্রেণিবদ্ধ করে যাচ্ছে চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো। এ নিয়েও উদ্বেগ কাজ করছে।
মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, দায়িত্বের শুরু থেকেই বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও অখণ্ডতার আরও বড় আকারের স্বীকৃতির জন্য চাপ দিয়ে এসেছি। মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এই আন্তঃনির্ভরতার বিষয়টিই সামনে নিয়ে এসেছে।
তার মতে, উন্নত ও শক্তিশালী সার্বজনীন জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। মহামারি এবং বর্তমান খাদ্য-জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে শিক্ষা নিতে হবে রাষ্ট্রগুলোকে। সামাজিক সুরক্ষায় অবশ্যই স্বাস্থ্য সেবা ও দারিদ্র্যের বিপরীতে মানুষের নিরাপত্তা সহজ করার বিষয়টি থাকতে হবে। পাশাপাশি খাদ্য, পানি, আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ অপরিহার্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি জানান, চিলির দুবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে বুঝতে পেরেছি দেশ শাসন কতটা কঠিন। একটি দেশের অনেক চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা থাকে, যার সমাধান করা দরকার। কিন্তু দেশ পরিচালনা করতে গেলে কোনো কোনো বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হয়। সেক্ষেত্রে মানবাধিকার অবশ্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আমার কার্যালয় কাজ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার রাজনৈতিক ইচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক ইচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইচ্ছা থাকলে উপায় বেরিয়ে আসবেই।
মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ন্যায্যতা দিতে কখনোই বিশেষ পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, কলোম্বিয়ায় যেসব কারণে সহিংসতা লেগে আছে, তার একটি কারণের সমাধানের মাধ্যমে সেখানকার কৃষক, আদিবাসী ও আফ্রিকান-কলোম্বীয় সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেয়া সহজ হবে।
তিনি জানান, হাইকমিশনার হিসেবে আমার চার বছরের মেয়াদে বহু সাহসী, উৎস্যুক ও অসাধারণ মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। যার মধ্যে আফগানিস্তানের অদম্য নারী মানবাধিকারকর্মীরা, মেক্সিকোয় নিখোঁজদের আত্মপ্রত্যয়ী মায়েরাও রয়েছেন। আবার গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বুনিয়ার অঞ্চলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উৎসাহী কর্মীদের সঙ্গেও কাজ করেছি। তারা যৌন সহিংসতায় আক্রান্তদের জন্য কাজ করছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জানান, পেরুর আদিবাসীদের তেজ ও প্রজ্ঞা দেখেছি। যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অবৈধ খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও গাছকাটার বিরুদ্ধে সম্মুখসারিতে থেকে কাজ করছেন। গুরুতর ঝুঁকিতে থেকেও তারা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন। এছাড়া বুরকিনা ফাসোর অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেয়া সম্প্রদায়গুলোর উদারতা ও সহমর্মিতাও আমাদের নজর কেড়েছে।
আরো পড়ুন>> জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান হকাররা
তিনি জানান, নাইজারের ঐতিহ্যবাহী গ্রামের নেতাদের মধ্যে আমি মৈত্রী খুঁজে পেয়েছি। তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে মানবাধিকার এগিয়ে নিতে তারা নিজস্ব উপায়ে কাজ করছেন। মালয়েশিয়া, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, কোস্টারিকাসহ বিভিন্ন দেশের তরুণদের সঙ্গে আমি দেখা করেছি, তাদের সম্পদ, সৃষ্টিশীলতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে নাড়া দেয়।
ভেনিজুয়েলার এক বাবার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা জানান তিনি। তাকে ওই বাবা নিজের কিশোর ছেলের ক্রীড়া পদক দেখান। ২০১৭ সালে ওই পদক পান তার ছেলে। এরপর বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সে নিহত হয়।
মিশেল ব্যাচেলেট জানান, স্রেব্রেনিকায় ২৭ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় বেঁচে থাকা মায়ের সঙ্গেও আমার চোখের পানি ভাগাভাগি করেছি। হয়ত একদিন সন্তানের দেহাবশেষ তিনি ফিরে পাবেন, আর বাবার কবরের পাশেই তাকে চিরশায়িত করা হবে।
এরপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে তার দেখা করার কথা উল্লেখ করেন তিনি। মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, এক শরণার্থী আমাকে জানিয়েছেন যে মিয়ানমারের স্কুলে তিনি ভালো রেজাল্ট করেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল, তিনি একদিন চিকিৎসক হবেন। কিন্তু তার বদলে গেল পাঁচ বছর ধরে তাকে শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করতে হয়েছে। তাকে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ তিনি একজন রোহিঙ্গা। অথচ তার বৌদ্ধ বন্ধু এরই মধ্যে চিকিৎসক হয়েছেন। ভেঙে যাওয়া সেই স্বপ্নের কথা স্মরণ করে এখনো কান্নায় তার চোখ ভিজে যায়।
তিনি জানান, শরণার্থী হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা ছিল স্বস্তিদায়ক। শিক্ষা ও মানসম্পন্ন জীবন আমি পেয়েছিলাম। নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনের যে গভীর আকাঙ্ক্ষা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখেছি, তা আমার মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, স্বেচ্ছায় সম্মানজনকভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। আর মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ ও কেয়িন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিন রাজ্য, বামারদের কেন্দ্রভূমি সাগেইং ও মাগওয়েতে সামরিক বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
গ্রামীণ ও আবাসিক এলাকাগুলোতে বিমান ও কামান হামলা তীব্রতা পেয়েছে। সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে আবার সহিংসতা বেড়ে যাওয়া এই আভাসই দিচ্ছে যে, দেশটির সর্বশেষ স্থিতিশীল এলাকাও সশস্ত্র সংঘাতের পুনরুত্থান ঠেকাতে পারছে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বারবার তাতমাদো ও আরাকান আর্মির যোদ্ধাদের সংঘাতের মধ্যে আটকা পড়েছে। আবার সামরিক বাহিনীর সরাসরি অভিযানেরও শিকার হয়েছে তারা।
মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, মিয়ানমারে নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান বন্ধে ও বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে যে সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে, সে জন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার অনুরোধ করছি।
ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিকদের ভোগান্তি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে বৈরিতা ফের শুরু হয়ে যেতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। সেখানে বেসামরিক নাগরিকদের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। নতুন লড়াই শুরু হলে তা তাদের জীবনকে আরও অস্বাভাবিক করে তুলবে।
কাজেই উত্তেজনা কমিয়ে আনার মাধ্যমে শত্রুতা বন্ধে ইথিওপিয়ার সরকার ও টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টকে অনুরোধ জানান মিশেল ব্যাচেলেট। এছাড়া ইয়েমেন, সিরিয়া, সাহেল ও হাইতির পরিস্থিতিসহ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংকটগুলোতে নতুন করে নজর দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি অনুরোধ জানান।