নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মাবা’দ। সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম দয়াল নবী সাইয়্যেদুল মুরসালীন মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও উনার আহলে বায়েতগণের প্রতি।
পবিত্র মেরাজুন্নবী এমন একটি বিস্ময়কর ঘটনা যে আল্লাহ্ এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন- সোবহানাল্লাজি আসরা বি আবদিহি লাইলাম মিনাল মাসজিদিল হারামি ইলাল মাসজিদিল আকসা। সোবহানাল্লাহ দিয়ে আয়াতের শুরু করে আল্লাহ্ নিজেই জানিয়ে দিলে আল্লাহ্র হাবীব (দঃ)এঁর মেরাজ বা ঊর্ধ্বগমন বড়ই আশ্চর্যজনক ঘটনা। একই সাথে উক্ত আয়াতে স্ব-শরীরে মেরাজ গমনের প্রমাণ স্বরূপ ‘বি আবদিহি’ শব্দটি তাৎপর্য্যপূর্ণ। কেননা ‘আব্দুন’ শব্দটি আবদ হতে যার অর্থ বান্দা আর বান্দা বলতে যার দেহ ও জীবন আছে অর্থাৎ শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয় রুহ ও দেহের সমষ্টিকে। তদুপরি বোরাক প্রেরণ ও বোরাক কর্তৃক নবী করিম (দঃ)কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্ব-শরীরে মেরাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। মেরাজ সংগঠিত হয়েছিলো হিজরি রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে। সে মতে আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার দিবাগত রাত পবিত্র শবে মেরাজ। ফারসি শব শব্দের অর্থ রাত ও আরবি মেরাজ শব্দের অর্থ ঊর্ধ্বগমন।
মহিমান্বিত এ রাতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (দ.) কে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমন করিয়েছেন। এ সময় তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিদার লাভ করেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে একই রাতে দুনিয়াতে ফিরে আসেন।
এ কারণেই রাতটি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। মুসলিম বিশ্ব অলৌকিক ও ঐতিহাসিক রাতটিকে শবে মেরাজ হিসেবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ মহিমান্বিত রাতটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ আদায়, জিকির-আসকার, মিলাদ শরীফ, দোয়া-দরুদ ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করে থাকেন।
মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায় । অর্থাৎ প্রকাশ্য নবুয়তের ২৩ বৎসর দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে । সে সময় হুজুর (দঃ) এর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন।
তিনটি পর্যায়ে মেরাজকে ভাগ করা হয়েছে । মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাছ পর্যন্ত মেরাজের অংশকে বলা হয়ে ইসরা বা রাত্রিকালীন ভ্রমন। বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে সিদরাতুল মোনতাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মেরাজ । সিদরাতুল মোনতাহা থেকে আরশে আজীম ও লা-মকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ই’রাজ; কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মেরাজ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে । কোরআন, হাদিসে মোতাওয়াতির এবং খবরে ওয়াহে দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মিরাজ প্রমাণীত।
শবে মেরাজের আমল: বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব “গুন্ইয়াতুত তালিবীন” নামক কিতাবে শবে মিরাজ-এর তথা রজব মাসে ২৭ তারিখের রোযার ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফগুলো বর্ণনা করেন। যেমন – হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রজব মাসের ২৭ তারিখে তথা শবে মিরাজ শরীফ-এর দিবাভাগে রোযা রাখবে তার আমলনামায় ৬০ মাসের রোযা রাখার ছওয়াব লেখা হবে। (সুবহানাল্লাহ) [তথ্যসূত্রঃ আল ইতহাফ- ৫ম খন্ড ২০৮ পৃষ্ঠা; আল মা’য়ানী আনিল হামলিল ইসফার, প্রথম খন্ড ৩৬৭ পৃষ্ঠা; গুনিয়াতুত্ তালিবীন; ক্বিসমুস্ ছায়ালিস-৩৩২ পৃষ্ঠা]। এ প্রসঙ্গে উক্ত কিতাবে আরো বর্ণিত আছে,-হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত সালমান ফারিসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উভয়েই বর্ণনা করেন। আখিরী নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “রজব মাসের এমন একটি দিন ও রাত আছে ঐ রাত্রে যে ব্যক্তি ইবাদত-বন্দিগী করবে এবং দিবাভাগে রোযা রাখবে তার আমল নামায় ঐ পরিমাণ ছওয়াব লেখা হবে যেই পরিমাণ ছওয়াব কোন ব্যক্তি একশত বছর রাতে ইবাদত-বন্দিগী করলে এবং একশত বছর দিনের বেলায় রোযা রাখলে তার আমলনামায় যেরূপ ছওয়াব লেখা হয়। আর সেই মুবারক রাত ও দিনটিই হচ্ছে রজব মাসের ২৭ তারিখ তথা পবিত্র শবে মি’রাজের রাত ও দিনটি।” (সুবহানাল্লাহ)
নামায ও রোযাঃ দুই রাকআত বিশিষ্ট ১২ রাকাআত নফল নামায। প্রতি রাকআতে- একবার সূরা ফাতিহা, ৩ বার/৭ বার/ ২১ বার সূরা ইখলাসসহ বা অন্য যেকোন সূরা পড়লে আদায় করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
নামায শেষে- ১০০ বার পড়ুনঃ সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। – ১০০ বার যে কোন ইস্তেগফার পড়ুনঃ আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিওঁ ওয়া আতুবু ইলাইহি; লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম। – ১০০ বার যে কোন দরুদ শরীফ পড়ুনঃ আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া বারিক ওয়া সাল্লিম।
এরপর পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহ পাকের নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের যেকোন কল্যাণকর দো’আ করুন এবং দিনে রোযা রাখুন। ইনশাআল্লাহ দো’আ কবুল হবে।
সুত্রঃ ইমাম হিন্দি (রহঃ) : কানযুল উম্মাল, খন্ড-১২, পৃষ্ঠাঃ ৩১২-৩১৩, হাদিস নম্বরঃ ৩৫১৭০, ইমাম গাজ্জালি (রহঃ) : এহইয়া উলুমুদ্দীন, ইমাম বায়হাকী (রহঃ) : বায়হাকী শরীফ, খন্ড-৩, পৃষ্ঠাঃ ৩৭৪, ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) : মাসাবাতা বিসুন্নাহ, পৃষ্ঠাঃ ৭০
শবে মেরাজের রোযা ১০০ বছরের ইবাদতের সওয়াব! হযরত সালমান ফারসী (রাদিঃ) হতে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন, রজব মাসের মধ্যে এমন এক দিন ও রাত আছে, যা বড় মর্যদাবান। যেই ব্যক্তি ঐ দিনে রোজা এবং রাতে ইবাদত করবে, আল্লাহ পাক তার আমলনামায় ১০০ বছর লাগাতার রোযা রাখা এবং ১০০ বছর রাত জেগে নামায পড়ার সওয়াব দান করবেন।(সুবাহানআল্লাহ) আর ঐ সময়টি হল, রজব মাসের ২৭ তারিখের (শবে মেরাজের) দিন ও রাত।
সুত্রঃ ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) : দুররুল মনসুর, আল জামেয়ুল কবীর, জামেয়ুল আহাদীস ওয়াল ওরাসিল, ইমাম বায়হাকী (রহঃ) : শুআবুুল ঈমান, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৭৪, হাদিস নং-৩৮১১।
হযরত মুহাম্মদ (দ.) উক্ত রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) এর সঙ্গে বোরাক নামক বাহনে চড়ে প্রথমে পবিত্র কাবা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করেন। সেখানে অন্যান্য নবী-রসুলের ইমাম হয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন, প্রমাণ হয় তিনি সকল নবী ও রাসুলদের সরদার। তারপর সেখান থেকে সপ্তম আসমান পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সফরে হযরত জিবরাইল (আ.)ও নবীজির (দ.) সঙ্গে পরিভ্রমণ করেন। এ সময় নবীজি (দ.) নভোমণ্ডল, বেহেশত-দোজখ ও সৃষ্টির বিভিন্ন রহস্য প্রত্যক্ষ করেন এবং পূর্ববর্তী নবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। পরে রফরফ নামক বাহনে চড়ে নবীজি (দ.) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরশে আজিম পর্যন্ত যাওয়ার ও মহান রব্বুল আলামীনের দিদার লাভের সৌভাগ্য লাভ করেন।
মেরাজের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো– অন্যান্য নবীগনের সমস্ত মোজেজা নবী করিম (দঃ) এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল । হযরত মুছা (আঃ) তূর পর্বতে খোদার সাথে কালাম করেছেন । হযরত ঈছা (আঃ) স্ব-শরীরে আকাশে অবস্থান করেছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (আঃ) স্ব-শরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন । তাঁদের চেয়েও উন্নত মকামে বা উচ্চ মর্যাদায় আল্লাহ্ পাক নবী করিম (দঃ) কে নিয়ে সবার উপরে তাকে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুছা (আঃ) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। আর আমাদের প্রিয় নবী করিম (দঃ) কে আল্লাহ্ তাআলা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিল সহকারে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়েছিলেন। সেখানে সমস্ত নবীগণকে স্ব-শরীরে উপস্থিত করে হুজুর করিম (দঃ) এর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগণের ইমাম হওয়াতে নবী করিম (দঃ) যে ‘নবীগণেরও সরদার’ তা বাস্তবে প্রমাণীত হয়েছিলো। সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাটু, নাক ও কপাল) দিয়ে স্ব-শরীরে নামাজ আদায় করেছিলেন সেদিন। তাতে সমস্ত নবীগণ আপন আপন মাযার শরীফে স্ব-শরীরে জীবিত, ইবাদতে মগ্ন এবং আল্লাহ্র ইচ্ছায় যেখানে দরকার হাজির হতে পারেন, তারই বাস্তব প্রমাণ হয়েছিল মেরাজের রাত্রে ।
মেরাজের রাত্রে নবী করিম (দঃ) কে প্রথম সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল (আঃ) ফেরেস্তাত্রয়ের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেস্তা দিয়ে। দ্বিতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল নবী (আঃ)গনের মাধ্যমে । তৃতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেস্তা ও হুর দিয়ে এবং চতুর্থ ও শেষ সংবর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা । সিদরাতুল মুনতাহা ও আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তাআলা একশত বার সংবর্ধনামূলক বাক্য ادن منى يا محمد অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মোহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন’– বলে নবী করিম (দঃ) কে সম্মানীত করেছিলেন। কোরআন মজিদে ثُمَّ دَنَا فَتَدَ لَّى আয়াতটি এদিকেই ইঙ্গিতবহ বলে তাফসীরে মুগ্নী ও মিরছাদুল ইবাদ গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে রিয়াজুন্নাছেহীন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাতশত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত।
পবিত্র শবে মেরাজ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আলোচনা সভা, মিলাদ ও মোনাজাতের আয়োজন করে থাকে। সেই সাথে দেশের সকল মসজিদ, মাদরাসা, খানকা-দরবার, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন ওয়াজ মাহফিল, আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে।