বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েট সংখ্যার তুলনায় চাকরির ক্ষেত্র খুবই সীমিত। যার দরুণ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো চাকরির সময় গ্র্যাজুয়েটদের খুবই স্বল্প বেতন নির্ধারণ করে থাকে। এর ফলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয় গ্র্যাজুয়েটদের। অন্যদিকে, গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর আমাদের মনোজগতে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। আমরা নিজেদের একটু ‘এলিট’ ভাবতে শুরু করি। চাকরির বিকল্প কোনো পেশায় আমাদের আগ্রহ থাকে না। নিজেরাই কাজের শ্রেণিবিভাগ করি। এর ফলে একটি বৃহৎ মেধাবী গোষ্ঠী ছুটছে স্বল্পসংখ্যক চাকরির পেছনে। আমরা জানি, এই দৌড়ে সবার জয়ী হওয়ার সুযোগ নেই। যারা হেরে যাবে তাদের মধ্যে হতাশা ও বিস্বাদ আক্রমণ করবে।
উদ্যোক্তা হওয়াকে অনেকেই ছোট করে দেখেন। এর যথেষ্ট কারণ আছে। উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হওয়া কিংবা ছোট আকারে হলেও টিকে থাকার মতো উদাহরণ আমাদের সামনে খুব বেশি নেই। কারণ আমাদের ইচ্ছা থাকে না, সম্যক জ্ঞান থাকে না, থাকে না কোনো পুঁজি- ফলে সফল হওয়ার কথাও নয়। সরকারি-বেসরকারি ঋণ, প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ খুব একটা পাওয়া যায় না। এগুলো থাকলে সত্যিই মাঠে নামা যেত। অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসায় এসব নিয়ে ‘এপপিরিমেন্ট’ করার সুযোগ তাদের থাকে না, সামর্থ্য ও সময়ও থাকে না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোক্তা হওয়াটা এক প্রকার বিলাসিতাই।
আশপাশে অনেককে এমন প্রবল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শারীরিক চাপে পিষ্ট হতে দেখে নব্য গ্র্যাজুয়েটরা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকেছে। তাদের এই ঝুঁকে যাওয়া প্রাথমিক দৃষ্টিতে খুবই অনুচিত মনে হলেও, এমনকি বাস্তবিকভাবে দেশের জন্য সত্যিই অনুচিত হলেও তাদের পক্ষে এটা ছাড়া আর পথ খোলা নেই। কেই-বা না চাইবে একটা স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা হোক।
সরকারি চাকরির দিকে গ্র্যাজুয়েটদের ঝুঁকে যাওয়ার অনেকগুলো খারাপ প্রতিক্রিয়া আছে। প্রথমত, একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে এর ফলে। হবেই বা না কেন? কয়েক হাজার চাকরির বিপরীতে যদি লাখ ছয়েক প্রতিযোগী থাকে, তখন প্রতিযোগিতাটা আর সুস্থ থাকার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এর আরও কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা-গবেষণার পরিবর্তে মুখস্থ করছে বাংলা-ইংরেজি-সাধারণ জ্ঞান। এসব কারণে মানসম্মত গ্র্যাজুয়েটও তৈরি হয় না।
বেকারত্বের পরিসংখ্যান রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। গত বছর এক জরিপে দেখা যায়, কভিড-১৯-এর জন্য বেকারদের সংখ্যা বেড়েছে ১০ গুণ। এর কারণ, কভিডের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে মোটাদাগে বেকারের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। যারাওবা চাকরি পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশেরই প্রথম দিকে বেতন অতি নিম্নমানের। আরেকটি জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও একই ফলাফল উঠে এসেছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে যে, স্নাতকোত্তর পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা স্নাতক পাস করা ৪২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেকারের চেয়েও বেশি। এর অর্থ হলো, যারা শুধু স্নাতক পাস করেছে, তারা কোনো রকম চাকরি বা কাজ পেলেই ঢুকে যায়।
কিন্তু যারা স্নাতকোত্তর করে ভালো ফল অর্জন করে, পছন্দমতো চাকরি না পাওয়ায় দীর্ঘদিন বসে থাকতে হয় তাদের। যারাওবা এসব পরিসংখ্যানে কর্মজীবী হিসেবে নথিভুক্ত, তারাও সবাই স্থায়ী চাকরিতে আসীন এমনটা না, একটা বড় অংশ খণ্ডকালীন চাকরিতে কর্মরত। এসব পরিসংখ্যানে আবার গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষের বেকারত্বের পার্থক্য সুস্পষ্ট। মোদ্দা কথা, কেউ যদি বাংলাদেশে বেকারত্বের পরিসংখ্যান মনোযোগ দিয়ে দেখে, তবে অদূর ভবিষ্যতের দুর্দিনের আভাস চোখে এড়াবে না।
এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে যদি নিকট ভবিষ্যতে আরও অর্ধশতক বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হয়, তা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল চালানো বৈ আর কিছু নয়। চাকরির বাজারে গ্র্যাজুয়েটের জোগান বেড়ে গেলে চাকরির চাহিদা বাড়বে, ফলে দামও কমবে তাদের। অসুস্থ প্রতিযোগিতা আরও অসহ্য আকারে দেখা দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় না গড়ে বরং প্রতি উপজেলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত সরকারি ডিগ্রি বা স্নাতক কলেজগুলোর বদলে ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল কলেজ তৈরি করলে তা কর্মসংস্থানে বেশি কাজে আসত। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে সেখানে প্রবেশ করাটা আরও কঠিন করলে শুধু সেরারাই সুযোগ পেত। সেরাদের সেরারা গ্র্যাজুয়েট হলে অন্তত তাদের চাহিদার অভাব থাকত না, মান নিয়ন্ত্রণ সহজ হতো। সবার স্নাতক-স্নাতকোত্তরের পথ কঠিন করে দেওয়ার এই প্রস্তাবনা অনেকে স্বাগত নাও জানাতে পারেন। মনে রাখা দরকার, দক্ষ মেধাবী গ্র্যাজুয়েট তৈরি না হলে শুধু সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সবাইকে সুযোগ দেওয়াটা ভুল হবে।
সমস্যা যেহেতু বহুমুখী, তাই দায় আমরা কেউই এড়াতে পারি না। আমরাই প্রত্যেকে কোনো না কোনো স্টেকহোল্ডার। আর এই জটিল অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি, এক দিনে বের হয়ে আসাও সম্ভব না। এখনই উদ্যোগ নেওয়া হলে কয়েক বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে। আর বিদ্যমান ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম গভীর সংকটে পড়বে। আমরা একটা দুষ্টচক্রে আটকে গেছি। যে কোনো দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার উপায় হলো কোনো একটা ধাপে জোর করেই ভাঙন করা। দেখার বিষয় শুরুটা করবে কে!
লেখকঃকবির অর্পণ