হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ হাঁটু উঁচু করে, উবু হয়ে বসে মলত্যাগ করে এসেছে। এ অভ্যাসে বড় পরিবর্তন এলো উনিশ শতকের মাঝামাঝি। দ্রুত নগরায়ন-শিল্পায়নের ফলে ইউরোপে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটল। নব্য ভোক্তাদের নিত্যনতুন পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে ইউরোপের বড় বড় শহরে বাণিজ্যমেলার আয়োজন শুরু করলেন ব্যবসায়ীরা। ১৮৫১ সালে লন্ডনের এক বাণিজ্যমেলায় এক ইংরেজ স্যানিটারি ব্যবসায়ী হাজির করল তার নতুন পণ্য হাই কমোড। নাম দিল ফ্লাশ টয়লেট। সেকালের লেটেস্ট গ্যাজেট!
টয়লেট ব্যবহারের জন্যে খরিদ্দারকে গুনতে হবে এক পেনি। সাথে একটা তোয়ালে ও চিরুনি ফ্রি। এমনকি পালিশ করে দেয়া হবে তার জুতো জোড়াও। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মানুষ ভিড় জমাল। সাড়ে পাঁচ মাস মেলা চলল। আট লক্ষ ২৭ হাজার ২৮০ জন মানুষ এক পেনি দিয়ে ফ্লাশ টয়লেট ব্যবহার করল। ব্যস! হাই কমোডের জয়জয়কার শুরু। উনিশ শতকের শেষদিকে ব্রিটেন থেকে এটি পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে অভিজাত ও বিত্তবানদের অট্টালিকা ও নামকরা হোটেলগুলোতে কমোড লাগানো হলো। জার্মানিতে প্রথম কমোড বসল রানি ভিক্টোরিয়ার প্রাসাদে। সাধারণ মানুষ বরাবরই অভিজাতদের অনুকরণ করে। ফলে বিংশ শতাব্দীতে এসে পাশ্চাত্যের বাসাবাড়িতে কমোড হয়ে গেল আবশ্যিক অনুষঙ্গ। আমাদের দেশে কমোডের প্রচলন হলো আশির দশকের শুরুতে। এখন প্যান হয়ে গেছে লো-ক্লাস
আর কমোড হচ্ছে জাতে ওঠার প্রতীক। পাশ্চাত্যে কিন্তু উল্টো স্রোত বইতে শুরু করেছে।
কমোড স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কমোডের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রথম সচেতন হলেন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় খ্যাতনামা মার্কিন পরিপাকতন্ত্রবিদ হেনরি বোকাস প্রণীত গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাঠ্যবই বোকাস গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি। এতে স্পষ্ট বলা হয়Ñ ‘মলত্যাগ করার সময় পেটের সাথে দুই উরু লেগে থাকবে। এটাই মলত্যাগের জন্যে সঠিক ভঙ্গি।’ আসলে কমোড কেন ক্ষতিকর তা বুঝতে শরীরে মল তৈরির প্রক্রিয়াটি আগে জানতে হবে। হজম ও বিপাকক্রিয়া শেষে খাদ্যবর্জ্য কোলনে এসে জমা হয়। শরীর অতিরিক্ত পানিটুকু শুষে নেয়, বাকিটা মলে পরিণত হয় ও মলদ্বারে পৌঁছায়। ইউ (ট) আকৃতির পেশি ‘পিউবোরেকটাইলিস’ এখানে মল ধরে রাখে। যখন আমরা ংয়ঁধঃঃরহম ঢ়ড়ংরঃরড়হ-এ বা বঙ্গাসনে বসি, পেশিটি শিথিল হয় ও সমস্ত টক্সিনসহ মল শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যখন কমোডে বসে কেউ মলত্যাগ করে, সংশ্লিষ্ট জায়গাটি সরু হয়ে যায়। ওপরদিকে চাপ পড়ে। মল নির্গমনের প্রক্রিয়া তখন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়।প্যানে বসলে মলদ্বার ও রেক্টামের মাঝের এঙ্গেলটি থাকে ১২৬ ডিগ্রি। কমোডে বসলে সেটা ২৬ ডিগ্রি কমে হয় ১০০ ডিগ্রি। ফলে পেটে স্বাভাবিকের চেয়ে চাপ বেশি পড়ে, পায়ুপথের শিরা টান খায় ও ফুলে যায়।
কমোড ব্যবহারে যে-সব রোগ হতে পারে
হেমোরয়েড : দীর্ঘদিন ধরে কমোডে যারা অভ্যস্ত তারা হেমোরয়েডে আক্রান্ত হতে পারেন। আমেরিকান কলেজ অব গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির পরিসংখ্যান মতে, বয়স ৫০ হওয়ার আগেই আমেরিকার অর্ধেক মানুষ হেমোরয়েডে ভুগতে শুরু করে। তাদের পায়ুপথের শিরা ফুলে থাকে। মলত্যাগের সময় রক্ত পড়ে। মার্কিন চিকিৎসকেরা তাই রোগীদের উদ্বুদ্ধ করছেন প্যানে বসে মলত্যাগ করতে। যে-সব রোগী উপদেশ মানছেন, তারা দ্রুত সেরে উঠছেন। কারণ কমোডের তুলনায় প্যানে বসে মলত্যাগ করতে সময় লাগে তিন ভাগের একভাগ। ইসরায়েলি চিকিৎসা-গবেষক ডাভ সিকিরভ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কয়েক ডজন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালালেন। তিন রকম টয়লেট আসনের ব্যবস্থা করলেন। একটা ১৬ ইঞ্চি উঁচু কমোড, দ্বিতীয়টা ১২ ইঞ্চি উঁচু আর বাংলা প্যান। দেখা গেল,কমোডে মলত্যাগ করতে রোগীদের সময় লাগছে
১৩০ সেকেন্ড। আর বাংলা প্যান ব্যবহার করলে মাত্র ৫১ সেকেন্ড। অভিজ্ঞতাও কমোডের চেয়ে স্বস্তিদায়ক।
কোষ্ঠকাঠিন্য : কলোরেক্টাল সার্জনদের মতে, মলত্যাগে যখন সময় বেশি লাগে, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এটি কিন্তু হেলাফেলার অসুখ নয়। কোষ্ঠকাঠিন্যকে এখন বলা হচ্ছে ‘অ্যান আমেরিকান এপিডেমিক’। কারণ আমেরিকায় ৪০ লক্ষ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে। আর ৩ কোটি ৩০ লক্ষ আমেরিকান ভুগছে অনিয়মিত কোষ্ঠকাঠিন্যে। প্রতি বছর ২৫ লক্ষ আমেরিকান কোষ্ঠকাঠিন্য-জনিত সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায় এবং ৯২ হাজার রোগীর অবস্থা এত গুরুতর থাকে যে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। আমেরিকায় প্রতি বছর ৮০ কোটি ডলারের ল্যাক্সেটিভ (মল নিষ্কাশনে সহায়ক ওষুধ) বিক্রি হয়। একবার ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ভোগান্তি বরং আরো বেড়ে যায়। ল্যাক্সেটিভ দীর্ঘমেয়াদে কেবল আপনার পরিপাকতন্ত্রের সর্বনাশই করে না, বাড়ায় করোনারি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও।
পেলভিক ফ্লোর ডিজঅর্ডার : মূত্রাশয়, মলদ্বার ও মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ুসহ পুরো জায়গাটিকে বলা হয় পেলভিক ফ্লোর। মূলত মলত্যাগ বাধাগ্রস্ত হলে বা মলত্যাগে নিয়ন্ত্রণ হারালে পেলভিক ফ্লোরের কার্যক্রমে গড়বড় দেখা দেয়। কোষ্ঠকাঠিন্য, মলদ্বারে ব্যথা বা ফুলে যাওয়া এবং ইউরিন লিকেজ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। অপারেশন ছাড়াই এই রোগ থেকে নিরাময়ের উপায় হলো আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত মেদ ঝেড়ে ফেলা ও মলত্যাগে সঠিক ভঙ্গি অনুসরণ। মলত্যাগের সময় হাঁটু যদি নিতম্ব থেকে উঁচু অবস্থানে থাকে, পেলভিক পেশি শিথিল হয়। সামনে কিছুটা ঝুঁকে ও কনুই হাঁটুর ওপর রেখে বসলে তা পেলভিক পেশির জন্যে বেশ উপকারী। বঙ্গাসনে বসলে এই সুবিধা পাওয়া যায় কিন্তু কমোডে বসে এটা সম্ভব না। এ-ছাড়া আইবিএস, ক্রনিক বাওয়েল ডিজিজ ইত্যাদি নানা রোগের অন্যতম কারণও কমোড ব্যবহার।
কমোড ছাড়ুন, প্যান ব্যবহারে অভ্যস্ত হোন পাশ্চাত্যের স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষেরা ধীরে ধীরে কমোড ছেড়ে বাংলা প্যানের প্রতি ঝুঁকছেন। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। হাই কমোড যথাসাধ্য বর্জন করুন। বাংলা প্যান ব্যবহার করুন। সুস্থ থাকুন।
তথ্যসূত্র : হার্ভার্ড হেলথ, এপ্রিল ২০১৯
অ্যাথেরোস্কে¬রোসিস, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
হেলথলাইন, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮; আমেরিকান
একাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস, সেপ্টেম্বর ২০১৫