লকডাউন এবং একটি সরল অংক

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ও তা থেকে নিরাপদ থাকতে অদ্য পর্যন্ত যতো রকমের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি নির্ণয় করা হয়েছে, তা কোন ভাবেই পুরোপুরি কার্যকর নয়। সকল সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরও দেশে বিদেশে অসংখ্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য পেশাজীবীর মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এগুলো শুধুই নিরাপত্তা ব্যবস্থা মাত্র, নিশ্চয়তা নয় কোন ভাবেই।  আবার অদ্য পর্যন্ত না পাওয়া গেছে কার্যকর কোন ভ্যাকসিন। এই বৈশ্বিক মহামারী ঠেকাতে ও তা থেকে নিরাপদ থাকতে লকডাউন, কেবল ও একমাত্র লকডাউন পদ্ধতিই চিকিৎসা বিজ্ঞান, সামাজিক সমাধান এবং হাদিস মোতাবেক সঠিক পন্থা। যার কোন বিকল্প নাই।

বাংলাদেশে গত ০৮ মার্চ করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। আমরা তা বুঝে উঠতে উঠতেই ১০দিন পার করে দিয়েছি। তারপর এলাকা ভিত্তিক ও সীমিত আকারের ভাগ-গুণ-যোগ-বিয়োগ করে করে ০৩ মাস পার করে দিলাম। তিন মাসে দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদনের যে ক্ষতি হয়েছে এবং এভাবে চললে আরও কতদিনে আরও কতো ক্ষতি হবে তার বিপরীতে ২০/৩০ দিনের কঠিন ও কঠোর লকডাউন কি উত্তম নয়?

পুরোদেশ তথা  শহর, বন্দর, গ্রাম এক সাথে লকডাউন করলে অসংখ্য মানুষ না খেয়ে মরবে। শুরুতে এই মতবাদের দুহায় দিয়ে মানবতার ধুম উঠে, চলে ব্যাপক ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। তখন লিখেছিলাম- ‘’ভাইয়েরা, একটু সবুর করুন-সঠিক সময়ের অপেক্ষা করুন। করোনা মহামারী বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো সাময়িক কোন দুর্যোগ না। এটি অস্থায়ী ও অনিশ্চিত সময়কালের মহামারী। আপাতত  ঘরে থাকুন- নিজে বাঁচুন, পরিবারকে বাঁচান।‘’ আমাকে অনেকেই সে সময় অমানবিক উপাধি দিয়ে কতরকম নীতিবাক্য শুনিয়েছেন। আজ কোথায় তারা, কয়জন না খেয়ে মরছে, কোথায় ত্রাণ কার্যক্রম। আজ বরং যুবক ফুটপাতে ছটফট করে মরছে যুবক, স্ত্রী হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রাস্তায় বসে স্বামীর মৃত্যুর অপেক্ষা করছে, এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে স্বামীর কোলেই স্ত্রীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ, বাবা সন্তানকে কাঁধে নিয়ে চিকিৎসা খুঁজছেন, লাশ ফেলে পালাচ্ছেন স্বজন। আরও কতো  অসহায়ত্ব, নির্মমতা দেখতে পাচ্ছি দেশ জুড়ে।  এসব খাবারের অভাবে নয়, চিকিৎসার অভাবে। করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার অভাব। আর এ জন্য লকডাউন না দেয়া ও ত্রাণ বিতরণের পক্ষের লোকগুলো অনেকাংশেই দায়ী।

আগেই বলেছি, করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে ও তা থেকে নিরাপদ থাকতে লকডাউনের কোন বিকল্প নাই। আমরা তিন মাস সময় পার করেছি এলাকা ভিত্তিক ও সীমিত আকারের লকডাউন দিয়ে। দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদন যেন ক্ষতির মুখে না পড়ে সে জন্য পূর্ণ লকডাউন এড়িয়ে গেছি। কিন্তু তাতে ফলাফল কি হয়েছে তা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে। রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, মহামারী ভয়ানক রূপ নিচ্ছে আর দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদন দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে নিশ্চিত। দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি পুষাতে না পেরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে, বেকার হচ্ছেন বিশাল জনশক্তি। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদি ভাবে। আয় বন্ধ, ব্যয় কিন্তু বন্ধ নেই- হাজারো সমস্যা ঝেঁকে বসছে সর্বত্র।

সমাধান একটাই, আর তা হচ্ছে লকডাউন। কঠিন ও কঠোর লকডাউন। তিনমাস সীমিত আকার সীমিত আকার করে করে যে মহাবিপদ ডেকে এনেছি তা না করে যদি কঠিন ও কঠোর ভাবে দেশব্যাপী ২০/৩০ দিনের ১০০% লকডাউন কার্যকর করা যায় এবং পরবর্তী ২/৩ মাস সীমান্ত ও সকল পোর্ট নিরাপদ করা যায় তবেই কেবল করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকানো সম্ভব। আর দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদনকে দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি থেকে রক্ষা করার সম্ভাবনা থাকবে। নচেৎ এক অনিশ্চিত আগামীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে।