ব্যাংক খাত ঝামেলায়: মুহিত

আবুল মাল আবদুল মুহিত।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। জাতীয় সংসদে ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন তিনি। শেয়ারবাজার, বেসিক ব্যাংক, একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা বিষয়ে সমালোচনাও ছিল তাঁর আমলে। ১২ জানুয়ারি নিজ বাসায় এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম ও নিজস্ব প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব। 

প্রথম আলো: এই সময়ের অর্থনীতিকে কেমন দেখছেন?

এ এম এ মুহিত: ব্যাংক খাত খুব ঝামেলার মধ্যে আছে। একে এভাবে চলতে দেওয়াটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। বর্তমান অর্থমন্ত্রী অনেক কথা বলেছেন, অনেক ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে এখনো বোঝা যাচ্ছে না তিনি ঠিক কী করতে যাচ্ছেন। মনে করেছিলাম যে আলাদা আলাদা ব্যাংক ধরে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। সেটাও শেষ পর্যন্ত হয়নি। অর্থাৎ বিষয়টা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে।

প্রথম আলো: কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন?

মুহিত: আমি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের শেষ দিকে বলেছিলাম ব্যাংক খাত নিয়ে কিছু ধারণা দিয়ে যাব। নতুন প্রশাসনের জন্য আমি তা পরামর্শ আকারে রাখতে চেয়েছিলাম, যাতে তারা প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করতে পারে। শেষ পর্যন্ত দিইনি। কারণ হচ্ছে আমার ধারণাগুলো অনেকের কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য হবে না।

প্রথম আলো: ব্যাংক খাত কি ঠিক আছে?

মুহিত: ব্যাংক খাতে দুর্বলতা আছে। বেসরকারির তুলনায় সরকারি ব্যাংকগুলোতে দুর্বলতাটা বেশি। বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও কম। যদিও বেসরকারি ব্যাংক নিয়ে অভিযোগ আছে যে আমি অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সরকার তাদের অনেক সুবিধা দিয়েছে। টানা ৯ বছর পরিচালক থাকা, একই পরিবার থেকে অনেক সদস্য পর্ষদে থাকা ইত্যাদি। দেশে বর্তমানে অনেক ব্যাংক থাকলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা কমে আসবে।

প্রথম আলো: বর্তমান অর্থমন্ত্রী যে বলেন অন্যান্য দেশের একেকটা শাখার সমানই আমাদের একেকটা ব্যাংক।

মুহিত: এটা সত্য। তবে অন্যান্য দেশ নয়, শুধু যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩০-এর দশকে বিশ্বমন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ হাজার ব্যাংক ছিল। মন্দার পর তাদের ব্যাংক খাত ঠিক হয়েছে। আর আমাদের ব্যাংক খাত তো এখনো অপরিপক্ব।

প্রথম আলো: ব্যাংকমালিকদের অনেক সুবিধা যে দিলেন, এখন কী মনে হয়, না দিলেও পারতেন?

মুহিত: আমাদের ইচ্ছা ছিল ব্যাংক খাতের প্রসার ঘটানো। সেই প্রসারতা অর্জন করতেই এত ব্যাংক দিয়েছি। তবে আমাদের এখানে ব্যাংকের চরিত্রটাই এমন যে একসময় এগুলো একীভূত হবে। এ নিয়ে অবশ্য বিশেষ চিন্তার কিছু নেই।

প্রথম আলো: একীভূত হওয়ার সে রকম আইন তো নেই দেশে।

মুহিত: আসলে করপোরেট ব্যবস্থাপনায় আমরা দুর্বল। ব্যক্তি এখানে ব্যাংকের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর একীভূত হওয়ার ব্যবস্থা এখনো আছে। নেই দেউলিয়া আইন। একটা ভুল করেছি আমি। ফারমার্স ব্যাংককে স্বাভাবিকভাবে মরতে দেওয়া উচিত ছিল।

প্রথম আলো: কেন মরতে দিলেন না?

মুহিত: ভয়ে। একটা মরে গেলে তার ক্রমিক প্রভাব পড়ে পুরো খাতে। এখন মনে হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংককে মরতে দিলে অসুবিধা হতো না।

প্রথম আলো: অন্তত বাকিরা সতর্ক হতো?

মুহিত: ফারমার্স ব্যাংকে শুরু থেকেই ডাকাতি হয়েছে। এটা কোনো ব্যাংক ছিল না।

প্রথম আলো: সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির বেলায়ও আপনি ‘ডাকাতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বেসিক ব্যাংক নিয়ে কিছু করতে পারলেন না কেন?

মুহিত: আবদুল হাই বাচ্চুর মতো একটা লোকই বেসিক ব্যাংক ধ্বংস করে দিল। আর আমরাও এতে পক্ষ (পার্টি) হয়ে গেলাম। ব্যাংকটা আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের খাতে ঋণ দিত। আমরাই শিথিল করে দিলাম। এটা ছিল একটা বড় ভুল।

প্রথম আলো: আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারলেন না কেন?

মুহিত: আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।

প্রথম আলো: রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে কি?

মুহিত: সে রকম নয়। সরাসরি রাজনীতি তিনি করতেনও না। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্য ধরনের রাজনীতিবিদ। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিল এবং এগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন।

প্রথম আলো: বেসিক ব্যাংক খারাপ হওয়ার পেছনে এই সংযোগই ছিল তাহলে কারণ?

মুহিত: অন্যতম কারণ।

প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের অবস্থা কিন্তু খারাপ।

মুহিত: এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে বাজারটা সব সময়ই ফাটকা বাজার হিসেবে থেকে গেছে। আসলে আমরা সঞ্চয় করি না, খালি খরচ করি। ভারতের সবাই সঞ্চয় করে। সম্পদ ভালো থাকলে খরচের প্রবণতা ভালো, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের আছে। তবে ধনী না হলেও আমি একজন বড় সঞ্চয়কারী।

প্রথম আলো: আপনার ধনী হতে ইচ্ছা করেনি?

মুহিত: না।

প্রথম আলো: কেন?

মুহিত: ধনী হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি।

প্রথম আলো: জীবনটাকে তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মুহিত: জীবন নিয়ে আমি খুবই সন্তুষ্ট। এই জীবনে যা চেয়েছি, তা-ই হয়েছে। চেয়েছি দেশ থেকে যেন দারিদ্র্য দূর হয়। এটা কমে এসেছে।

প্রথম আলো: মানুষ ধনী হতে চায় না, এটা কোনো স্বাভাবিক কথা?

মুহিত: একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেলে বেশি ধনী হওয়ার দরকার পড়ে না। লোভ আসলে মানুষকে শেষ করে দেয়। আমার কোনো লোভ নেই। আর কয়েক লাখ টাকার মালিক হয়েও ধনী ভাবা যায়।

প্রথম আলো: কোন পদক্ষেপের জন্য মানুষ আপনাকে মনে রাখবে বলে মনে করেন?

মুহিত: প্রবৃদ্ধি। এখানে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা শহর-গ্রামনির্বিশেষে হয়েছে। ধনী-গরিবনির্বিশেষেও হয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ এত বড় দেশ যে অর্থনীতিটা এখানে সমন্বিত। এমন সমন্বিত দেশ বিশ্বে পাওয়া খুব মুশকিল। ঢাকা ও পঞ্চগড়ের পণ্যমূল্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায় না। এটাই আমাদের অর্থনীতির বড় কৃতিত্ব এবং আমি মনে করি এতে আমার যথেষ্ট অবদান আছে।

প্রথম আলো: কোনো আক্ষেপ নেই আপনার?

মুহিত: একটা আছে, বলব না। তবে পুঁজিবাজারটা সংহত ও সাবলীল হলো না, এটা একটা আক্ষেপ। আইনকানুন প্রণয়ন করে কিছুটা শুদ্ধ করতে চাইলেও কার্যকর কিছু হয়নি।

প্রথম আলো: বিএসইসির (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) চেয়ারম্যানকে তো আপনি শেষবার নিয়োগই দিতে চাননি, তাই না?

মুহিত: বিএসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে মাঝখানে একটা আলোচনায় বসেছিলাম। এটা ঠিক। তাঁকে শেষবার নিয়োগ দিতে চাইনি। কারণ, বিধির বাইরে যেতে চাইনি আমি। সেই বিধি ভাঙা হলো আর আমিও তা গ্রহণ করলাম। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আক্রোশ ছিল না আমার, বরং আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।

প্রথম আলো: রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নগামী। মাঝখানে সংজ্ঞা পরিবর্তন করে ঋণখেলাপিদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আপনিও সুবিধা দিয়েছিলেন।

মুহিত: ঋণখেলাপিদের আর বাড়তি সুবিধা দেওয়ার পক্ষে নই আমি। অনেক দেওয়া হয়েছে। আমার ইচ্ছা ছিল যে রূপরেখাটা আমি তৈরি করার চিন্তা করেছিলাম, তাতে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে ঋণখেলাপিদের জন্য। এর মধ্যে টাকা দিতে হবে। না পারলে ঋণখেলাপি হয়তো মরবে না, কিন্তু ব্যবসা করতে পারবে না। অর্থাৎ যা আছে, তা-ই নিয়ে তাকে থাকতে হবে, নতুন ব্যবসা করতে পারবে না।

প্রথম আলো: ব্যাংকিং কমিশন নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?

মুহিত: এটাতে খুব একটা নজর দিইনি। ব্যাংকিং কমিশন হলে ভালোই হবে। তবে চিন্তা করতে হবে, কীভাবে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। নইলে খামোখা একটা কমিশন করে লাভ কী?

প্রথম আলো: আপনি কী করতে চেয়েছিলেন?

মুহিত: চেয়েছিলাম কমিশন করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করি। তারপর যত বছরই লাগুক, বাস্তবায়ন করি।

প্রথম আলো: রিজার্ভ চুরি, আপনি জানলেন ২২ দিন পর।

মুহিত: আমি জানলাম ফিলিপাইনের সূত্রে খবর বেরোনোর পর। খুবই নাখোশ হয়েছিলাম যে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা জানাল না। তৎকালীন গভর্নর অবশ্য পরে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে তিনি ভেবেছিলেন বিষয়টা সামলে নিতে পারবেন। এত বড় একটা জিনিস, জানানোটা তাঁর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

প্রথম আলো: অর্থ তো উদ্ধার হলো না। শুরুতে কি ভুল পদক্ষেপ ছিল?

মুহিত: না। আমরা কাকে অর্থ দিয়েছি? দিয়েছি নিউইয়র্ক ফেডকে। তারা দায় এড়াতে পারে না।

প্রথম আলো: মামলায় তো তাদের নামই নেই।

মুহিত: ব্যাংক চলে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এখানে বিশ্বাসের খেয়ানত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের যে সাধারণ মান রয়েছে, তা নষ্ট করেছে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক। এটিকে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না।

প্রথম আলো: আপনার সময়ে তো ব্যাংকগুলোর মালিকানা বদলে গেল। ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল…।

মুহিত: তাতে কী করব আমি? এক দল বিক্রি করেছে, আরেক দল কিনেছে। এতে ভুল দেখি না। বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকের মালিক কারা, অনেকে তা জানেনই না। যেমন টাটা কোম্পানি। মাত্র ৬ শতাংশের মালিক হয়ে বড় বড় কোম্পানি পরিচালনা করে তারা!

প্রথম আলো: বাইরে থেকে সিদ্ধান্ত দিয়ে সুদের হার কমানোর উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন।

মুহিত: সুদের হার বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলে তা ভালো কাজ করে না।

প্রথম আলো: নতুন সময় দেওয়া হয়েছে এপ্রিল। কী করা উচিত?

মুহিত: ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসা উচিত। ব্যাংকগুলোকে নিজেদেরই কাজটি করতে দেওয়া দরকার।

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে খুব বেশি প্রশংসা করতেন না।

মুহিত: এ নিয়ে আমি খুব একটা কিছু বলতাম না। আতিউর রহমান এটাকে মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন বেশি। আমারও তাতে খুব আপত্তি ছিল না। এতে খুব ক্ষতি হয়েছে বলেও মনে করি না।

প্রথম আলো: কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা স্বাধীন হওয়া উচিত?

মুহিত: স্বাধীন হওয়া উচিত। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাঝেমধ্যে অপ্রত্যাশিত আচরণ করে। ফলে নিয়ন্ত্রণটাও দরকার। একটা উদাহরণ দিই। বিশ্বব্যাংকে আমাদের পক্ষে একজন ভারতীয় নির্বাহী পরিচালক ছিলেন, যিনি মূলত একজন পরিবহন-যোগাযোগবিষয়ক অর্থনীতিবিদ। তিনি অনেক গবেষণা করে আমাকে জানালেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রায় ২০০টি ছোট কারিগরি সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং এগুলোতে একেকজন পরামর্শক রয়েছেন। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমি একটু অবাক হলাম। পরীক্ষা করে দেখা গেল এগুলো মোটামুটি অপচয়মূলক ও অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ। আমরা ঠিক করলাম, এগুলো বন্ধ করে দেব।

প্রথম আলো: বন্ধ করতে পেরেছিলেন?

মুহিত: পেরেছিলাম। তবে বেশ সময় লেগেছে। এক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা যা আছে, সেই স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করছিল এসব অপচয় ও বিশৃঙ্খলা। সুতরাং, যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এ-জাতীয় কাজ করে, সরকারকে তখন বাধ্য হয়ে কিছু করতে হয়। আমি মনে করি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা যেমন থাকা উচিত, তেমনি সেই স্বাধীনতা ভোগ করার ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট সতর্ক এবং যত্নশীলও থাকা উচিত।

প্রথম আলো: বাংলাদেশকে নিয়ে আপনি কী স্বপ্ন দেখেন?

মুহিত: বাংলাদেশ একদিন সমৃদ্ধ দেশ হবে। সেই পথেই আছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী যে ২০৪১ সালের কথা বলেছেন, ঠিকই ওই সময়ের মধ্যে তা অর্জিত হবে। এটা কোনো বাগাড়ম্বর নয়। তখন সম্পদেরও সুষম বণ্টন হবে। তবে ৯ থেকে ১০ শতাংশ জনসংখ্যাকে সব সময়ই রাষ্ট্রীয় সহায়তার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় রাখতে হবে তাদের। বঙ্গবন্ধু শুরুর দিকে একবার বলেছিলেন বাংলাদেশ হবে সুইজারল্যান্ড। সে দিকেই যাচ্ছি আমরা। ইউরোপের সুইজারল্যান্ড বরফের দেশ আর আমরা হলাম পানির দেশ। সুইজারল্যান্ডে কিন্তু সব গ্রাম, শহর খুবই কম। এর প্রধান কারণ হলো বিদ্যুৎ। বাংলাদেশেও সেই অবস্থা বিরাজ করছে। ৯৭ শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।

প্রথম আলো: কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিও যে বাড়ছে?

মুহিত: দুর্নীতি কমে যাবে।

প্রথম আলো: কিসের ভিত্তিতে বলছেন কমে যাবে? দর্শনটা কী?

মুহিত: দুর্নীতি হয় তখন, যখন মানুষের অনেক কিছুই অপূর্ণ থাকে। এটা আর থাকবে না। অনেকেই দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অভ্যাস বদলানোর জন্য নতুন প্রজন্মের দরকার। মনে হয় নতুন প্রজন্ম অল্প সময়ের মধ্যেই দায়িত্ব নেবে। তখন দুর্নীতি কমাতে লম্বা সময় লাগবে না।

প্রথম আলো: প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হলে দুর্নীতির মাত্রা বাড়ে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু দিন দিন দুর্বল হচ্ছে?

মুহিত: এটা সত্য। প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া উচিত। দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কোনো ক্ষতি হবে না।

প্রথম আলো: যেমন?

মুহিত: আমাদের খাদ্য খাতের একটা বড় অংশ হলো খাদ্যগুদাম। এর কোনো দরকার নেই। এটা আড়তদাররাই করবে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ (কিল) করা বেশ কষ্ট। আমার ৬০ বছরের কর্মজীবনে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পেরেছি। সেটা হলো ওয়্যার হাউজিং করপোরেশন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেছেন, বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) বা জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মতো সংস্থা থাকার প্রয়োজন নেই। আপনি কী মনে করেন?

মুহিত: আমারও মনে হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো বন্ধ করে দেওয়া যায়। জ্বালানির জন্য যে কত সংস্থা আছে!

প্রথম আলো: ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের পার্থক্য ১ থেকে ২ শতাংশ থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন।

মুহিত: সঞ্চয়পত্র ও আমানতের সুদহারে এত পার্থক্য থাকা উচিত নয়। আসলে ২০১৫ সালে একবার ছাড়া আমিও তা কমাতে পারিনি। যদিও এর পক্ষে সরকারের অনেক যুক্তি আছে। যে যুক্তি আবার ভুল। আবার সরকারের অনেকে ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর বিরোধিতা করে থাকেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও চলে সেই বিরোধিতা। অনেক সময় ব্যক্তিগত লোকসান হতে পারে। কিন্তু এটা মেনে নিতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি কখনো ব্যক্তিগত লোকসানে পড়েছেন?

মুহিত: অনেক আগে। তবে এখন আমি সঞ্চয়পত্র ছাড়া আর কোথাও টাকা রাখি না। এই যে অনেকে লিজিং কোম্পানিতে টাকা রাখেন। আমার কোনো পয়সা এসবে নেই। ১৯৯১ সালের পর কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করিনি। আর আমি এ দেশের পুরোনো বিনিয়োগকারীদের একজন।

প্রথম আলো: সঞ্চয়পত্রের সুদ কমলে তো আপনার লোকসান হবে?

মুহিত: এটা কোনো বিষয় নয়। আমি তো ভালো মুনাফা পাই। এখন আমি ধনী মানুষ।

প্রথম আলো: আপনার সময় কাটে কীভাবে?

মুহিত: একটা বই নিয়ে ১৯৮০ সাল থেকে কাজ করছি। শেষ করতে আরও ছয় মাস লাগবে। আমার জীবন নিয়ে তিনটি বই করেছি। বর্তমান কাজটি শেষ হলে জীবনের চতুর্থ খণ্ড নিয়ে লিখতে শুরু করব।

প্রথম আলো: আমলাতন্ত্র কি এখন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে? অযৌক্তিক কিছু সামনে এলে আগে আমলারা মন্ত্রীদের বোঝাতে পারতেন। এখন তেমনটা হয় বলে শোনা যায় না।

মুহিত: আপনি কি নিশ্চিত? আমার মনে হয় আমলা ও মন্ত্রীদের মধ্যে এখনই সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক আছে। এখন মন্ত্রীরা আমলাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন না। মন্ত্রীরা মনে করেন আমরা যেমন দেশের সেবা করছি, আমলারাও তা-ই করছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুহিত: আপনাদেরও ধন্যবাদ।