করোনা পরিস্থিতির কারণে সাধারণ ছুটির মধ্যেই দ্বিতীয় দিনের মতো ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ঘাটে ঢাকামুখী পোশাক শ্রমিকদের ঢল নেমেছে। পাবলিক পরিবহন বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটে ও বিকল্প পন্থায় আসছে তারা।
আগামীকাল রোববার পোশাক কারখানা খোলা থাকার কারণে ঢাকামুখী গার্মেন্টস কর্মীদের স্রোত অব্যাহত রয়েছে। ময়মনসিংহে থেকে গার্মেন্টস কর্মীদের স্রোত আজও যাচ্ছে ঢাকার দিকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ছোট ছোট যানবাহন করে, পায়ে হেঁটে ময়মনসিংহ আসছেন। ময়মনসিংহ নগরী থেকে ৮/১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে দিগারকান্দা, শিকারীকান্দা এলাকায় গিয়ে ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, সিএনজি অটোরিকশায় করে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। আবার যানবাহন না পেয়ে অনেকে পায়ে হেঁটেই ঢাকার দিকে রওয়ানা দিয়েছেন।
শ্রমিকরা জানান, ৫ তারিখ থেকে গার্মেন্টস খোলা। আগেই ঢাকায় যেতে গার্মেন্টস থেকে বলা হয়েছে। সে কারণে করোনার ভয় নিয়ে কষ্ট করেই রওনা হয়েছেন তারা। যেতে না পারলে চাকুরি চলে যাবে বলে জানান তারা। তবে সরকারী-বেসরকারী অফিসে ছুটি থাকলেও তাদের ছুটি না থাকায় ক্ষুব্ধ তারা। ময়মনসিংহ সদর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মাসুদ রানা জানান, শুক্রবার থেকে হাজার হাজার মানুষ স্রোতের মতো ঢাকার দিকে যাচ্ছে। আজ শনিবারও একই অবস্থা। মহাসড়কে মানুষের ঢল নেমেছে। যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই যাচ্ছেন অনেকে।
এদিকে, মানিকগঞ্জের দৌলতদিয়া ফেরিঘাটেও একই চিত্র। একই চিত্র মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে, রাজধানীমুখী যাত্রীদের ঢল নেমেছে। শনিবার সকাল থেকেই কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাত্রীদের চাপ দেখা গেছে। এর মধ্যে গার্মেন্টসে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি।
বেসরকারি ও গার্মেন্টসকর্মীদের ঢাকায় ফিরতে আজ শনিবার দুপুর থেকেই দৌলতদিয়া ঘাটে প্রচণ্ড ভিড় চলছে । এতে সামাজিক দূরত্ব মানতে পারছে না তারা। ফলে করোনাভাইরাস ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অসংখ্য মানুষ শনিবার দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে এসে ভিড় করেছে পদ্মা পাড়ি দেয়ার জন্য। লঞ্চ ও অন্য ট্রলার পারাপার বন্ধ থাকায় শত শত মানুষ গাদাগাদি করে ফেরিতে পার হচ্ছে।
মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক আব্দুল আলিম জানান, সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর এই নৌরুটে চলাচলকারী ১৭টি ফেরির মধ্যে ১৪টির চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তবে, জরুরী প্রয়োজনে এ্যাম্বুলেন্স ও সরকারী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পারাপারের জন্য ৩টি ফেরি সীমিত আকারে চলাচল করে। হঠাৎ করেই সকালে যাত্রীদের চাপ বেড়ে গেছে। লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা ফেরিতে পারাপার হচ্ছে। অনেকেই আবার ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে পাড়ি দিচ্ছেন পদ্মানদী।
দু’দিন ধরে আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে হাজারও শিশু-কিশোরসহ নারী-পুরুষ যে যেভাবে পারছেন ময়মনসিংহ থেকে আসছেন। কিন্তু ময়মনসিংহের পাটগোদাম ব্রিজেরমোড়ে যানবাহন না পেয়ে আরও ৫-৬ কিলোমিটার হেঁটে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দিঘারকান্দা বাইপাসমোড়ে গিয়ে অতিরিক্ত ভাড়ায় ট্রাক, পিকআপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন। অনেকেই পাঁয়ে হেঁটেই ঢাকার দিকে রওয়ানা দিয়েছেন। চাকরি রক্ষা ও বেতনের সময় হওয়ায় করোনাভাইরাসের ভয় নিয়েই রওনা হয়েছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকরা বলছেন, অফিস খোলা, কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। তাই বাধ্য হয়েই ছুটছেন তারা। আজ সকালে দেখা গেছে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকামুখী মহাসড়কে এখন অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যান আর ট্রাকভর্তি শুধু মানুষ আর মানুষ। এমন চিত্র দেখা যায় ঈদের সময়। এই যাত্রীদের গন্তব্য গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। বিশেষ করে তাদের অধিকাংশই গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মী। এই সময়ে প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে বের হতে মানা করা হয়েছে, তারপরও তারা বের হয়েছেন-জানতে চাইলে কয়েকজন বলেন, তারা নিরুপায়। পেটের দায়েই বের হতে হয়েছে তাঁদের। ভাবতে হচ্ছে পরিবারের ভবিষ্যতের কথা।গতকালের মতো আজকেও ময়মনসিংহ শহরের পাটগুদাম ব্রিজ মোড়, বলাশপুর ও মাসকান্দা বাইপাস এলাকায় প্রচুর মানুষ। তারা সবাই কর্মস্থলে ফিরছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কর্মমুখী মানুষ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-পথ পারি দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে পায়ে হেঁটে, ভ্যান-ট্রলি এবং পিকআপ ভ্যানে করে নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটছেন পোশাক শ্রমিকরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন বাসট্যান্ডে ঢাকামুখী যাত্রীরা কেউ হেঁটে যাচ্ছেন আবার যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো তারা ভ্যান বা পিকআপে করে ছুটে চলছেন ঢাকার দিকে। পাটুরিয়া ঘাট থেকে ঢাকার নবীনগরের ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা আর সেখানে এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজে যাওয়ার জন্য ভাড়া গুনতে হচ্ছে একশ টাকা তবুও অতিরিক্ত টাকা দিয়েই যাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা।
ঢাকার আশুলিয়ার পোশাক কারখানার শ্রমিক আনোয়ার মিয়া বলেন, কারখানা খুলে গেছে তাই যাচ্ছি। আজ কারখানায় উপস্থিত না হতে পারলে যে কয়দিন ছুটি পাইছি সে কয়দিন অনুপস্থিত দেখাবে কর্তৃপক্ষ। যার কারণে অতিরিক্ত টাকা দিয়েই কারখানায় যাচ্ছি।
সমর নামে আরো এক পোশাক শ্রমিক বলেন, আমি গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করি, পাটুরিয়া ঘাট থেকে নবীনগরের যে ভাড়া তার চেয়ে পাঁচ সাত গুণ ভাড়া চাচ্ছে পিক-আপ ভ্যানের চালকরা, আমার কাছে এত টাকা নাই তাই বাধ্য হয়েই হেঁটে যাচ্ছি।
মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মানিকগঞ্জের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে আঞ্চলিক গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া কাটা গাড়িও বন্ধ আছে এবং এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। গতকাল থেকে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-পথ পারি দিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ঢাকামুখী এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করার পর তারা দেশের বাড়িতে ফিরেছিল। রোববার (৫ এপ্রিল) থেকে গার্মেন্টস ও বেসরকারি কোম্পানির অফিস খেলা থাকার কারণে চাকরি টিকিয়ে রাখতে পায়ে হেটে, কখনো মোটরসাইকেল, কখনো ভ্যানসহ বিভিন্ন থ্রি হুইলার অথবা ট্রাকে চেপে বাড়তি ভাড়া বিনিময়ে ঢাকার উদ্দেশে তাদের যাত্রা করতে হচ্ছে।
এক্ষেত্রে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি তেমন ভ্রুক্ষেপ করছেন না সাধারণ মানুষ। এদিকে গণজমায়েত বন্ধ ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বরিশালে অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল হুদা জানান, জেলাটিতে এখন পর্যন্ত এক দোকান মালিকসহ ১২ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষকে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। অপরদিকে পুলিশও চেষ্টা করছেন যাতে করে সামাজিক দুরত্ব বজায় থাকে। তাই বাসস্ট্যান্ডসহ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে পুলিশ সদস্যদের তৎপরতা দেখা গেছে।