নিষেধাজ্ঞার বলি ইরানের উড়োজাহাজ শিল্প
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যু আবার সামনে নিয়ে এসেছে দেশটির ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। বিভিন্ন সূত্র থেকে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ান হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে থাকা অপর যাত্রীরাও নিহত হন। বিধ্বস্ত হওয়ার পর হেলিকপ্টারটি পুড়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে বিভিন্ন সূত্রে। এমন দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে কেন এত পুরনো হেলিকপ্টারে চড়েছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যুর পর দেশটির উড়োজাহাজ শিল্পের দুর্বলতা আবার সামনে এসেছে। মূলত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ইরানের উড়োজাহাজ শিল্প বিকশিত হতে পারেনি। যার ফল বিভিন্ন সময়ে তাদের ভোগ করতে হয়েছে। যে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইব্রাহিম রাইসি ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ান নিহত হয়েছেন, সেটিও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। বিবিসি জানায়, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা বেল-২১২ মডেলের। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের কাছে এমন কোনো হেলিকপ্টার বিক্রি করেনি যুক্তরাষ্ট্র। যার অর্থ দাঁড়ায় ওই হেলিকপ্টার ছিল বেশ পুরনো। এই বেল-২১২ এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই হেলিকপ্টারটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। এর আগে ২০১৮ সালে এ ধরনের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয় ইরানে, যেখানে চারজন নিহত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এভিয়েশন সেফটি এজেন্সির তথ্য অনুসারে, বেল-২১২ ক্রুসহ ১৫ জনকে বহন করতে পারে। এ হেলিকপ্টারে বায়বীয় অগ্নিনির্বাপকসহ অন্যান্য যন্ত্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সিএনএন-এর সামরিক বিশ্লেষক সেড্রিক লেইটনের মতে, হেলিকপ্টারটিতে খুচরা যন্ত্রাংশ যুক্ত করতে না পারার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
ইরানের অ্যাভিয়েশন বা উড়োজাহাজ শিল্প ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট জানায়, ১৯৭৯ সালের পর থেকে ইরানের বেসামরিক বিমান চলাচল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর বিধিনিষেধের আওতায় চলে আসে। ২০০৭ সাল থেকে আরও নিয়মতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় দেশটির ওপর। পরবর্তী সময়ে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হলে ইরান পশ্চিমা নির্মাতাদের কাছ থেকে ২০০’র বেশি উড়োজাহাজ কিনতে চায়। যার মধ্যে মাত্র তিনটি এয়ারবাস এবং ১৩টি ফরাসি-ইতালীয় টার্বোপ্রপস ২০১৮-২০১৯ সালে তাদের দেওয়া হয়েছিল। এরপর আবার পুরোদমে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ফিরে আসে। এ নিষেধাজ্ঞাগুলোর আওতায় ছিল, বিদেশি বিমানবন্দরে যাওয়া ইরানি উড়োজাহাজকে যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তিগত পরিষেবা না দেওয়া। এমনকি ইরানি বাহনগুলোকে জ্বালানি সরবরাহেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যার কারণে দেশটির উড়োজাহাজগুলোকে ভারী জ্বালানি বয়ে বেড়াতে হতো।
পাঁচ বছর আগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য মতে, তেইশটি ইরানি এয়ারলাইনস প্রায় ৩০০ (৪৮,০০০ আসনের) মোট বহরের মধ্যে ১৫৬টি নিজস্ব মালিকানাধীন বা ভাড়া করা উড়োজাহাজ (২৬,৬২৬ আসন) পরিচালনা করতে পারে। যার অর্থ তাদের প্রায় অর্ধেক বাহন খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে বসে থাকে। ওই সময়েই বলা হয়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। প্রতি বছর বহরের আরও আট শতাংশ পরিষেবার বাইরে চলে যাবে বলে ধারণা করা হয়। তখন ইরানের বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার প্রধান আলি আবেদজাদেহ নিষেধাজ্ঞার কারণে এ শিল্প কঠিন সময় পার করবে বল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি জানান, ইরানের বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পুরনো ফকার ১০০ এবং বোয়িং এমডি যেগুলো দ্রুত অবসরে চলে যাবে।
সব দিকে বাধা
ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এমন সব উড়োজাহাজের ওপরও ছিল যেগুলোতে ১০ শতাংশের বেশি মূল মার্কিন যন্ত্রাংশ রয়েছে। এমনকি রাশিয়ার তৈরি বিমান যেমন ‘সুখোই সুপারজেট এসএসজে১০০’ ইরানের পক্ষে কেনা অসম্ভব। কারণ এতে ১০ শতাংশের বেশি মার্কিন যন্ত্রাংশ এবং ব্যবস্থা রয়েছে। এ সংকট দূর করতে ‘অল রাশিয়ান’ উড়োজাহাজ তৈরির সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন ব্যয়সাপেক্ষ এবং পশ্চিমা কোনো বাহন ব্যবহারের মতো সুলভ নয়। তখনকার হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল পর্যন্ত ইরানের ৫৮০টি উড়োজাহাজ প্রয়োজন ছিল। যদিও এর কাছাকাছি সংখ্যা দেশটি পূরণ করতে পারেনি। পুরনো উড়োজাহাজ বেশি জ্বালানি পোড়ায়। ইরানের বাহনগুলো আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে দেড়গুণ বেশি জ্বালানি পোড়াত। যদিও দেশটি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পাঁচটি তেল শোধনাগারে জেট ফুয়েলের উৎপাদন বাড়ায়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্রমবর্ধমান খরচ মেটাতে আফগানিস্তান, ইরাকি কুর্দিস্তান এবং আর্মেনিয়ায় সীমিত চালান বাদে অন্য দেশে উদ্বৃত্ত জ্বালানি রপ্তানি করতে পারে না তারা। ইরানের এভিয়েশন কর্র্তৃপক্ষের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তাদের যাত্রী সংখ্যা ক্রমে কমছে।
এরপর ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, শুধু উড়োজাহাজ নয় রেল শিল্পেও ধুঁকছে ইরান। উড়োজাহাজ এবং ট্রেনের অভাবে যাত্রী সংকটে ভুগতে হচ্ছে দেশটিকে। সে বছর ইরানের সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রধান মোহাম্মদ মোহাম্মদি বখশ ঘাটতি দূর করতে বহরে বাহনের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি বলে জানান। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান প্রয়োজন ৫৫০টি প্লেন, কিন্তু আমাদের কাছে মাত্র ১৮০টি প্লেন আছে। ফ্লাইট সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের বিমান বহরে ৩৭০টি নতুন প্লেন যুক্ত করতে হবে। মোহাম্মদি বখশ আরও বলেন, ইরানের ৩৩০টি নিবন্ধিত উড়োজাহাজের মধ্যে ১৩৯টি বর্তমানে বসে আছে। তিনি বলেন, এর মধ্যে কয়েকটি বাহন চলাচলের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ইরানের একটি সংবাদমাধ্যম জানায়, দেশটির বেসামরিক বিমান ১৯৯০ এর দশক থেকে সংকটের সম্মুখীন। সংকট মোকাবিলায় তারা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে পুরনো প্লেন ভাড়া বা খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বহরের প্রযুক্তিগত অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হয়, যার ফলে পরিস্থিতি এখন সংকটময় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন সংকটের মধ্যেও সর্বশেষ চলতি বছর এপ্রিলে ইসরায়েলে ড্রোন হামলা চালানোর পর ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আসে। ইউরোপের সাতটি দেশ ইরানের উড়োজাহাজ শিল্পের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার কথা বিবেচনা করছে বলে জানায় ব্লুমবার্গ। যার ফলে ইউরোপে ইরানের ফ্লাইট সংখ্যা আরও কমে যাবে। একই সংকটে পড়েছে রাশিয়াও। তাদের উড়োজাহাজও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। যে কারণে তারা ইরানের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি সমঝোতায় আসার চেষ্টা চালায়। ইউক্রেনে হামলার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ান বিমান সংস্থাগুলো বাধ্য হয় রক্ষণাবেক্ষণ এবং যন্ত্রাংশের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজতে। রাশিয়ান বিমান সংস্থাগুলোও উড়োজাহাজ পরিচালনায় পশ্চিমা যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন বা আমদানিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ইরান এবং রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলায় তাদের সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টায় আছে। এ বিষয়ে গত বছর ইরানের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন কিরগিজস্তানে বৈঠক করেন।
প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার
প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দোল্লাহিয়ানসহ অন্য কর্মকর্তাদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি উড্ডয়নের প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায় যে, উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেহেদি সাফারি দাবি করেন তিনি বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার থেকে ফোনে রাইসির সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন। ইরানের রেড ক্রিসেন্টের প্রধান পীর-হোসেন কোলিভান্দের মতে, সেনাবাহিনী, বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং পুলিশ ইউনিটসহ কমপক্ষে ৭৩টি উদ্ধারকারী দল ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের তাভিল গ্রামে বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার থেকে প্রেসিডেন্টকে উদ্ধারে অভিযানে নামে। সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ইরানের অনেক সামরিক উড়োজাহাজ এখনো ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের সময়কার। আলজাজিরার হিসাবে, তখন থেকে প্রায় দুই হাজার ইরানি প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।
রাইসিকে নিয়ে বিধ্বস্ত কপ্টারটির বয়স সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মডেল কানাডার সামরিক বাহিনীর জন্য ১৯৬০ সালে তৈরি করা হয়েছিল। মার্কিন কোম্পানি বেল হেলিকপ্টার ওই উড়োজাহাজগুলো নির্মাণ করে। বিশ্বজুড়ে অনেক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সেগুলো ব্যবহার করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং থাইল্যান্ড পুলিশের মতো বাহিনীগুলোতেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। ফ্লাইটগ্লোবালের ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড এয়ার ফোর্সেস ডিরেক্টরি অনুযায়ী, ইরানের নৌ ও বিমান বাহিনীর কাছে মোট ১০টি বেল হেলিকপ্টার রয়েছে।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ইরানের বিমান চলাচল খাতের দুর্বলতার একটি প্রধান কারণ দেশটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব। যার কারণে নতুন বিমান কেনা বা যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন তাদের জন্য। এ কারণে এয়ারলাইনসগুলোকে যন্ত্রাংশের জন্য কিছু প্লেন খুলে অন্য বাহনে তা যুক্ত করতে হচ্ছে। ইরানের নেতৃস্থানীয় এয়ারলাইনস ইরান এয়ার এবং মাহান এয়ারের ব্যবহৃত বিমানের গড় বয়স ২০ বছরের বেশি এবং কিছু ক্ষেত্রে ৩০ বছরেরও বেশি। অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক ২০০০ সাল থেকে ইরানে ২২টি মারাত্মক দুর্ঘটনা রেকর্ড করেছে। অবশ্য ১৯১৯ সাল থেকে ১৫২টি দুর্ঘটনার রেকর্ডও রয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ রাশিয়ান নির্মিত উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হলে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস করপোরেশনের কর্মীসহ ২৭৫ জন নিহত হয়।
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন বলেছেন, ইরান গণমাধ্যমগুলোকে এখন পর্যন্ত কোনো চক্রান্তের কথা বলেনি। ভয়াবহ আবহাওয়া পরিস্থিতিই তাদের খবরে উঠে এসেছে এবং এই দুর্ঘটনার জন্য সেটিকেই একমাত্র কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। যাই হোক, প্রেসিডেন্ট রাইসির অনেক শত্রু ছিল। তিনি মারা যাওয়ায় খুশি হবেন অনেকে। খারাপ আবহাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তা হলো, বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকায় ইরানের এয়ারক্রাফটগুলো অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। কারণ, তারা স্পেয়ার পার্টস (খুচরা যন্ত্রাংশ) বা এয়ারফ্রেম (নতুন কাঠামো) পেত না।