যে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এত কিছু, সেখানে কি-না জানা গেল, খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাগরিকত্বের কোনো কাগজপত্র নেই; জন্মসূত্র তিনি ভারতীয়। তথ্যের অধিকার আইনে (আরটিআই) মোদির নাগরিকত্ব নিয়ে এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে এমনটাই জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর (পিএমও)। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা আনন্দবাজার রোববার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি শুভঙ্কর সরকার নামে এক ব্যক্তি আরটিআই-এর মাধ্যমে জানতে চান প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের কাগজপত্র রয়েছে কি-না। তারই উত্তরে পিএমওর সচিব প্রবীণ কুমার জানান, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী জন্মসূত্রেই ভারতীয়।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভের মধ্যেই এই তথ্য চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে খোদ রাজনৈতিক মহলে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধী ও সমর্থকদের সংঘর্ষে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারতের দিল্লিতে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৪২ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। পুলিশের সামনেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ মুসলিমদের অসংখ্য বাড়িঘর ও দোকানপাটে বেছে বেছে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি দিয়ে মুসলমানদের প্রকাশ্যে পেটানো হয়েছে। সিএএ-এর জেরে ভারতে সবচেয়ে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছেন সেখানকার মুসলমানরা। তাদের প্রতিটা দিনই কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
তবে মোদির নাগরিকত্বের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এ জবাবকে ‘অস্পষ্ট’ বলেছে ভারতের হায়দরাবাদের উর্দুভাষী পত্রিকা সিয়াসাত। সিমি পাশা নামের এক প্রবীণ সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘১৯৫৫ সালের ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যদি তার নাগরিকত্ব নিবন্ধনের প্রয়োজন না হয়, তাহলে অন্যদের বেলায় এ নির্দেশ কেন?’
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এর আগে একাধিকবার জানানো হয়, ২০১১ ও ২০১৫ সালের জাতীয় জনগণনা পঞ্জি অনুসারে যাদের পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে, এই পরিচয়পত্র যাদের কাছে পাওয়া যাবে না তারা নাগরিক না। তবে দেশের জনগণের বড় অংশের কাছেই সেই পরিচয়পত্র নেই। আর এ কারণেই বিরোধীরা বরাবর একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন-যদি এই বিরাট গোষ্ঠী দেশের নাগরিকই না হয়ে থাকে, বিজেপি তাহলে কাদের ভোটে পেয়ে ক্ষমতায় এল। অবশ্য তার জবাব দেননি মোদি।
নতুন নাগরিকত্ব আইনে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে পাড়ি জমানো হিন্দু, শিখ, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা নাগরিকত্ব পাবেন বলে বিধান রাখা হয়েছে। তবে এই আইনে দেশটিতে আশ্রয় নেয়া মুসলিমদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কোনও কিছুই বলা হয়নি। গত বছর ভারতের পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হয়ে যাওয়ার পর দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে সব ধর্মের মানুষ এর বিরোধিতায় বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভ দমনে ভারতের নিরাপত্তাবাহিনীর সহিংস অভিযানে কয়েক ডজনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
গত বছরের আগস্টে আসামের চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিক তালিকা প্রকাশ হয়। এই তালিকা থেকে সেখানকার প্রায় ১৯ লাখ মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব হারান। এই ১৯ লাখ মানুষ তখন থেকেই তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করে আসছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানায়, আসামে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) বাস্তবায়নের সময় নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে জমি এবং ব্যাংকের কাগজপত্রের নথি গ্রহণ করে ভারত সরকার।
তবে দেশটির আদালত বলেছেন, ভোটার আইডি কার্ড, জমির রাজস্বের রসিদ, ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং স্থায়ী অ্যাকাউন্ট নম্বর (প্যান) কার্ডের কোনোটিই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। কয়েক দশক ধরে ভারতে বসবাস করে এলেও গত বছরের আগস্টে এনআরসির পর বিদেশি ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এক নারী আবেদন করলে আসামের গুয়াহাটি হাইকোর্ট তার এ আবেদন নাকচ করে দেয়।
আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরির পর অসংখ্য মানুষ নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের ‘ডিটেনশন’ক্যাম্পে বন্দি রাখা হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ভারতের আসামেই রয়েছে ছয়টি বন্দিশিবির। জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) ঘিরে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে বন্দি রাখা হয় ওই সব শিবিরে। গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়, আসাম রাজ্যে দেশটির সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির নির্মাণের কাজ চলছে। আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে গোয়ালপাড়ার মাতিয়ায় ২৫ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে এই ডিটেনশন ক্যাম্প বা বন্দিশিবির। ২৫ বিঘা জমির ওপর নির্মাণাধীন দেশটির সবচেয়ে বড় বন্দিশিবিরের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি রুপি। বন্দিশিবিরের চারদিকে তোলা হয়েছে ২০ থেকে ২২ ফুট উঁচু দেয়াল। আসাম সরকারের সূত্র উল্লেখ করে সংবাদ মাধ্যম জানায়, আরও ১০টি বন্দিশিবির তৈরি করা হবে আসামে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আসামে ছয়টি বন্দিশিবির তৈরি হয়। তবে বন্দিশিবিরের বিষয়টি সবসময়ই অস্বীকার করে আসছে ভারত সরকার।