করোনায় কাবু চীন, ভুগবে বহু দেশ

অতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাস—যা খালি চোখে দেখা যায় না। অথচ এই অতিক্ষুদ্র ভাইরাসটিই নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে চীনকে। শুধু চীনই নয়—গোটা বিশ্বই এখন আতঙ্কিত এই ভাইরাসের দাপটে।

বলছি নভেল করোনাভাইরাসের কথা। গেলো বছরের ডিসেম্বরে প্রথম এই ভাইরাসে আক্রান্ত একজনকে শনাক্ত করা হয় চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে। এরপর এর প্রকোপ বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে আজ তা আর শুধু চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ৩৯টি দেশে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস, অদূর ভবিষ্যতে যে আরও বহু দেশে ছড়িয়ে পড়বে না তা এই মুহূর্ত বলা কঠিন।

নতুন নভেল করোনাভাইরাসের উৎস চীনের বাইরে সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই। এতদিন শুধু চীনে গুরুতর হলেও এবার এর বাইরেও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এটি। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। আর ভাইরাসের উৎসস্থলের বাইরে সর্বাধিক মৃত্যু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে।

চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) জানায়, করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৭১৫ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৭৮ হাজার ৬৪ জন। দেশটির মূল ভূখণ্ডের বাইরে মারা গেছেন আরও ৪৮ জন। বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৯৬৭ জন।

চীনের বাইরে করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটিতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৪৬ জনের শরীরে এনসিওভি-১৯ শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে মারা গেছেন অন্তত ১১ জন।

ইরানেও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে করোনাভাইরাস। দেশটিতে অন্তত ৯৫ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন অন্তত ১৬ জন। তবে, সরকারি এই হিসাবের সঙ্গে একমত নয় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। তাদের দাবি মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে করোনাভাইরাসে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া করোনাভাইরাসের কোনো চিকিৎসা তো নেই বরং বিশ্বের তাবৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও এটি প্রতিরোধের কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা প্রতিষেধক তৈরির জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন।

তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, প্রতিষেধক তৈরি করা গেলেও সময় লাগবে প্রায় ৬ থেকে ১২ মাস। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়টায় উহান, হুবেই তথা পুরো চীন পৃথিবীর জন্য ভয়ের কারণ হিসেবে রয়ে যাবে। আর এই ভীতি একদিকে যেমন চীনের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তেমনি অন্যদিকে শ্লথ করে দেবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চাকা।

করোনাভাইরাসে মৃতের ও আক্রান্তের শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে ‘হু’ (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন)-এর তরফেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস শুধু মানুষের জীবন নয়— এখন চীনের অর্থনীতির জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর চীন যখন হুমকিতে, তখন বৈশ্বিক অর্থনীতিও নিরাপদে থাকতে পারছে না।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ কমে যেতে পারে। অথচ করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের আগে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ।

অথচ উহান এলাকাটি চীনের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অটোমোবাইল বা গাড়ি নির্মাণশিল্প। নিসান, হোন্ডা ও জেনারেল মোটরসের মতো বড় বড় কারখানা আছে উহানে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এসব কারখানা বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের অংশ হিসেবে উহানে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে।

যেহেতু চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিক জিডিপিতেও এর প্রভাব পড়বে বা বলা যায় পড়তে শুরু করেছে। কারণ, বিশ্বের মোট উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ আসে চীন থেকে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চীনে যাওয়া পর্যটকের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। অথচ চীন বর্তমানে বিশ্বে পর্যটনের অন্যতম বৃহৎ স্থান।

চীনের কারখানাগুলো বন্ধ থাকার অর্থ হচ্ছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এলোমেলো হয়ে যাওয়া। বর্তমানে বৈশ্বিক ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত প্রায় ৮০ শতাংশ উপাদান যায় চীন থেকে। পৃথিবীতে তৈরি প্লাস্টিকের তৈরি ফুলের ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে শি জিনপিংয়ের দেশ।

বৈশ্বিক পরিসরে যারা খুচরা ব্যবসা করে, যেমন— আসবাব বিক্রির প্রতিষ্ঠান এবং কফির প্রতিষ্ঠান স্টারবাকস, তারা চীনে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। বেশ কিছু বিমান সংস্থা চীনে তাদের ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে এবং আন্তর্জাতিক হোটেল সংস্থা যারা পৃথিবীজুড়ে হোটেল ব্যবসা চালায়, তারা খদ্দেরদের তাদের হোটেল বুকিংয়ের অর্থ ফেরত দিতে চেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি হাইউনডাই তাদের গাড়ি তৈরির কাজ স্থগিত করে দিয়েছে চীন থেকে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সরবরাহের অভাবের কারণে।

এর সম্ভাব্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব যে ভবিষ্যতে গাড়ির বাজারে পড়তে যাচ্ছে এটা থেকে স্পষ্ট তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গাড়ি নির্মাণ শিল্পে এবং ইলেকট্রনিক্স শিল্পে যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী দেশ হিসেবে চীনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বহু মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার চীনে তৈরি হয়। অনেক ফোন এবং কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি হয় চীনে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় চিকিৎসা খাতে। সুতরাং এই খাতেও চীনসহ বিভিন্ন দেশের ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

সে কথা স্বীকার করেছেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংও। করোনাভাইরাসকে চীনের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৪৯-এ কমিউনিস্ট চায়না প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এটাই সব থেকে বড় ‘হেলথ এমার্জেন্সি’।… আমাদের এই ভুলগুলো সব ঠিক করতে হবে। এটা আমাদের জন্য কঠিন এবং একই সঙ্গে চরম পরীক্ষার সময়।’

এর আগেও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মন্তব্যে উঠে এসেছিল করুণ ছবি। তিনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাসে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দুর্বলতা ধরা পড়েছে। তা সারাতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলা ১১৫০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে সরকার।