ঈদের আগে থেকে রাজধানীর বাজারগুলোতে সয়াবিন তেলের চরম সংকট। ঈদের পরও একই অবস্থা। কোথাও সয়াবিন তেল নেই। তেলের সন্ধানে বিভিন্ন দোকান ঘুরে হয়রান ভোক্তারা। ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পরদিন লিটারপ্রতি এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর মজুদ করা কিছু বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে আসে এবং নতুন দামে বিক্রি করে দোকানদাররা।
আজ রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, নিউমার্কেট ও মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ঘুরে দেখা দেখা যায়, সয়াবিন তেলের বোতলে মূল্য লেখা ১৬০ টাকা, বিক্রেতারা নিচ্ছেন ১৯৮ টাকা। এর প্রমাণও পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘনের দায়ে একটি দোকানকে জরিমানা করা হয়। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, সয়াবিন তেল সরবরাহ পরিস্থিতি তদারক করতে কারওয়ান বাজারে তদারকি হয়। এ সময় আগের কেনা বোতলজাত সয়াবিন তেল যেখানে মূল্য লেখা আছে ১৬০ টাকা, কিন্তু বর্তমান রেটে ১৯৮ টাকায় বিক্রি করছে। এই অপরাধে কিচেন মার্কেটের শাহ মিরন জেনারেল স্টোরকে ভোক্তা দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করতে প্রাথমিকভাবে কম জরিমানা করা হয়েছে। পরে এসব অপরাধ করলে বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি মামলাসহ প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হবে বলে জানান তিনি।
বাজার ঘুরে, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মজুত করা তেল আস্তে আস্তে লুকানো গুদাম থেকে বেরিয়ে আসছে। যেগুলো আগের দামে কেনা অথচ বিক্রি করা হচ্ছে নতুন দামে।
ঈদের তিন-চার দিন আগে বাজার থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে গত ৫ মে নতুন দাম কার্যকর হওয়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও অলিগলির কিছু দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি শুরু হয়। এসব তেল মূল্যবৃদ্ধির আগে কিনে রাখা। তেলের বোতলের মোড়কে উল্লেখ করা দরও আগের। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে, যা আগের চেয়ে প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বেশি। এরপরও কোথাও কোথাও ‘খুচরা ২ টাকা না থাকার অজুহাতে’ সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে অর্থাৎ ২০০ টাকা লিটার বিক্রি করতে দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেল কোম্পানিগুলো শনিবার থেকে পরিবেশকদের মাধ্যমে নতুন দামে বোতলজাত, খোলা সয়াবিন ও পাম ওয়েল সরবরাহ শুরু করেছে। কিন্তু খুচরা বাজার পর্যায়ে সব এলাকায় এই তেল এখনো পৌঁছায়নি। নতুন মূল্যের তেল সরবরাহ স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন সময় লেগে যাবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।
রাজধানীর নিউমার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি দোকানে তেল সামান্য পরিমাণে আছে। বাকি দোকানে পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এর মধ্যে কিছু দোকানে গত শনিবার নতুন দামে তেল সরবরাহ করেছেন পরিবেশকেরা। বাকি দোকানের সব তেল আগের দামের, কিন্তু বিক্রি করছেন নতুন দামে। যদিও প্রায় সব দোকানেই ১ লিটার তেল ১৯৮ টাকার বদলে ২০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সরকার খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নির্ধারিত দামের চেয়ে কেন বেশি টাকা রাখা হচ্ছে, জানতে চাইলে জামান ট্রেডার্সের ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘বেশি দামে কেনা, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি।’ কারওয়ান বাজারে দোকানিরা জানান, শনিবার দুপুরে এক গাড়ি তীর সয়াবিন তেল নিয়ে আসেন পরিবেশক। বাজারের প্রায় দোকানে তারা ২ লিটার বোতলের এক কার্টন (৯ বোতল) ও ১ লিটারের এক কার্টন (১৮টি) দিয়েছেন। তবে কয়েকটি পাইকারি দোকানে কিছুটা বেশি দিয়েছেন।
হাতিরপুল বাজারের মুদিদোকান থেকে ১ লিটার সয়াবিন তেলের একটি বোতল কেনেন বেসরকারি চাকরিজীবী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পুরোনো তেল দিয়ে নতুন দাম রেখেছে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৯৮ টাকা লিটার, সেই দাম রাখতে পারত। সেই দামের চেয়েও ২ টাকা বেশি, ২০০ টাকা রেখেছে তারা।’
আলিম স্টোরের দোকানি বলছেন, ‘পরিবেশকরা সরবরাহ করা তেলের বোতলের মূল্য লেখা অংশ মুছে তেল দিচ্ছে। এগুলো আগের তেল। এ নিয়ে ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। তা ছাড়া, পরিবেশকেরা যে পরিমাণ তেল সরবরাহ করছেন, তা দিয়ে চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আমাদের দৈনিক চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ তেলও দিচ্ছেন না পরিবেশকেরা।’
সরবরাহকৃত তেলের বোতলে মূল্য লেখা অংশটি মুছে দেওয়া প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘এমন হওয়ার কথা নয়। মূল্য অংশটি মুছে তেল সরবরাহ করছি না আমরা। আগের দামেই (লিটার ১৬০ টাকা) তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। কারণ যেগুলো উৎপাদন করা আছে, সেগুলো তো গোডাউন থেকে বের করতে হবে। নতুন তেল সরবরাহ না করা পর্যন্ত ১৬০ টাকা লিটারই রাখার কথা।’
তিনি জানান, কারওয়ান বাজারে শনিবার তারা চারটি তেলের ট্রাক পাঠিয়েছেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, নিউমার্কেটেও তেলের ট্রাক গেছে। এ ছাড়া, দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত তেল পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা।
একই কথা বলেছেন টিকে গ্রুপের পরিচালক (অর্থ ও পরিচালনা) মো. শফিউল আতহার। তিনি বলেন, ‘আগে উৎপাদন করা আমাদের পুষ্টি তেল আমরা পুরনো দামেই (১৬০ টাকা) সরবরাহ করছি। নতুন দামে এখনো তেল সরবরাহ শুরু হয়নি।’ ক্রেতাদের বোতলের গায়ে দাম দেখে কেনার পরামর্শও দেন তিনি।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘খুচরা বাজারে দু-এক দিনের মধ্যে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
চলতি মে মাসে এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি জাহাজে করে অপরিশোধিত ৩ কোটি ৬৩ লাখ লিটার সয়াবিন ও পাম তেল এসেছে। এসব তেলের প্রায় পুরোটাই খালাস করে বন্দরের পাশের ট্যাংক টার্মিনালে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে সয়াবিন ও পাম তেল নিয়ে কোম্পানিগুলো নিজস্ব কারখানায় পরিশোধনের পর পরিবেশকদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করবে।