সিডনিতে দালালদের চক্রে পড়ে সর্বস্বান্ত অভিভাষণ প্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা; অতিষ্ঠ বাংলাদেশী কমিউনিটির ব্যবসায়ীরাও

    উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রা এবং উন্নত দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ী বসবাস এবংনিরাপদ ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশীর সংখ্যা অনেক। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে যে কোন মূল্য চুকাতেও দ্বিধা করেননা তারা, এমনকি কেউ কেউ জীবনমরণ পণও করে নেন। আর এই চাহিদা ও সুযোগের যথেচ্ছা ফায়দা নেয় দালালচক্র। তাই দালাল চক্রের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়া, আত্মহত্যা করা, জেল-জরিমানা, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন হারানো- এসব নতুন কিছু নয়। তবুও থামছে না এ প্রক্রিয়া, হচ্ছেনা কোন প্রতিকার!

    অস্ট্রেলিয়ার সিডনি কেন্দ্রীক এমনই একটি দালাল চক্রের ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা উঠে এসেছে অভিভাষণ প্রত্যাশী কতিপয় শিক্ষার্থীর অভিযোগে। তাদের অভিযোগে সেই চক্রের মূলহোতা হিসেবে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মানিকগঞ্জের আব্দুর রহিম সুমনে নাম এসেছে। যদিও এলাকায়, ঢাকায় ও অস্ট্রেলিয়ায় সে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। তবে প্রবাসে তাকে পাসপোর্ট নাম আব্দুর রহিম সুমন ওরফে বনফুল সুমন নামেই চিনে। অভিযোগে বল হয়, তারা শুধু অভিভাষণ প্রক্রিয়া নিয়েই নয় বরং প্রতারণার জন্য এই চক্র নানান বাহানা ও পন্থা ব্যবহার করছে। বাদ যাচ্ছেন না অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির ব্যবসায়ীরাও। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এ সকল ব্যবসায়ীরা নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসে নিজেদের অজান্তেই দালাল চক্রের ভয়ঙ্কর জালে আটকে পড়ছেন।

    সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়া অভিভাষণ প্রত্যাশী কতিপয় শিক্ষার্থী এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরলেন তাদের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (নাম জানলে টাকা ফেরত না পাওয়াসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের আশঙ্কায়) এই শিক্ষার্থীরা অভিভাষণের প্রত্যাশায় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি কেন্দ্রীক বাঙ্গালী কমিউনিটির একটি দালাল চক্রকে টাকা দেয়। সুদীর্ঘ সময়েও স্পন্সর না পাওয়া, জব না হওয়া, স্কলারশিপ না পাওয়া ও টাকাও ফেরত না পেয়ে এখন অসহায় এবং সর্বস্বান্ত এসব শিক্ষার্থীরা।

    প্রতারক দলের প্রধান আব্দুর রহিম সুমন দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদেরকে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে বলে জানায় তারা।

    তাদের মতে, আব্দুর রহিম সুমনের আরেকটি অপকর্ম হচ্ছে কর (Tax) প্রতারণা। অভিভাষণ প্রত্যাশী বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের নামে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ট্যাক্স অফিস থেকে GST এর নামে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের স্পনসরশীপের জন্য প্রয়োজন বলে তার নিকটজনদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। আর তারাও একজন দেশের মানুষের উপকার করার মানসে সকল তথ্য দিয়ে থাকেন। সেইসব তথ্য কাজে লাগিয়ে সুমন অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ট্যাক্স অফিস থেকে GST’র নামে  প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয়। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটির অসংখ্য ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ এবং একই সাথে ক্ষুন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সুনাম। যা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের তথ্যে বাংলাদেশিদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

    আব্দুর রহিম সুমনের সাথে যুক্ত গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের সিনিয়র সিটিজেন নামক একটি সংগঠনের উচ্চ পদস্থ পদধারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে।

    ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের অনুসন্ধানে দুদক। প্রায় অর্ধশত পোশাক কারখানা মালিক দুদকের নজরদারিতে রয়েছে।

    যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ‘র প্এরকাশিত একপ্রতিবেদনে  বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। যার পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। সুত্র- দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইনকিলাব-২৩.০২.২০২১

    তাদের অন্যতম মদদদাতা হিসেবে উচ্চারিত নামটি হচ্ছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, আরিফ নীটস্পিন ও এনআর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নারায়ণগঞ্জের মোখলেসুর রহমান। যিনি বিগত কয়েক বছরে অস্ট্রেলিয়াতে রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। মোখলেসুর রহমানের নিজস্ব ভবনেই আব্দুর রহিম সুমনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সুমন ঐ বিল্ডিংয়েই এগোরা নামে সুপারশপ পরিচালনা করছে। যদিও বাংলাদেশের এগোরার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। মোখলেসুর রহমান একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সম্মানিত লোক হওয়ায় আব্দুর রহিম সুমন তাকে শেল্টার হিসেবে নিয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন কমিউনিটির বিশিষ্টজনরা। কমিউনিটির অনেকের ধারণা হয়তোবা মোখলেসুর রহমানের অজান্তেই সুমন তার নাম ভাঙ্গিয়ে অপকর্ম করে যাচ্ছে। তারা বলেন, উনার বিল্ডিংয়ে সুমনের অফিস থাকায় কেউ কেউ মোখলেস সাহেবের সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে করছেন- যা কেবলই অনুমান নির্ভর।

    আব্দুর রহিম সুমনের দখলে আছে কয়েকটি রেস্তুরা, যা সে অবৈধভাবে জবরদখলে রেখেছে। ব্ল্যাকমেইলিং করে, এমনকি মানুষকে আটকে রেখে টাকা আদায় করাতেও আব্দুর রহিম সুমনের দখল বেশ পোক্ত। আব্দুর রহিম সুমন পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় তার জীবন শুরু করে। কালক্রমে এসব নানা প্রতারণার মাধ্যমে বর্তমানে সে প্রচুর টাকার মালিক ।

    অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী কমিউনিটির বিশিষ্টজন, কমিউনিটি লিডার ও সিটি কাউন্সিলর মোহাম্মাদ জামান টিটু এবং ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার, বিশ্লেষণ ও মতামত নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আগামী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।