যে বিষয়গুলো ক্যারিয়ার নির্বাচনের আগে মাথায় রাখা জরুরি

 

  • Save

তুমি যদি একজন শিক্ষার্থী হয়ে থাকো, ক্যারিয়ার শিক্ষা নিয়ে এই লেখাটি অবশ্যই এবং অবশ্যই তোমার জন্য। “ক্যারিয়ার” – বেশ ভারি আর গাম্ভীর্যপূর্ণ এই শব্দটি স্কুল জীবন থেকেই আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ক্লাস ফোরে পড়া একটা বাচ্চাও জানে লেখাপড়া শেষ করে তাকে চাকরি করতে হবে। ক্যারিয়ার শিক্ষা নামের বইটি আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হলেও বাস্তবতা হলো, জীবনের এত প্রয়োজনীয় একটা বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই।

১।ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এ সবথেকে জরুরী

অনেকের মতে  ক্যারিয়ার মানেই চাকরি। এর বাইরে যে আরও অনেক সম্মানজনক ক্যারিয়ার আছে, তা আমরা জানিই না। সবার কথা শুনে যখন একটা ক্যারিয়ার পথ বেছে নেই, দেখা যায় সে কাজ করতে গিয়ে তা আর ভালো লাগছে না।

এ সমস্যার সমাধান একভাবেই করা যায়। শুরুতেই নিজের ক্যারিয়ার  প্ল্যানিং- এ সচেতন হওয়া, আর সে হিসেবে নিজেকে তৈরি করা।

  • Save

২। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করবো কীভাবে?

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নিজের শক্তিশালী আর দুর্বল দিক সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনি ধারণা পাওয়া যায় পছন্দের ক্ষেত্রগুলোতে কাজের সফলতার সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে। নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে অবশ্য এই পদ্ধতি বিশেষ কোনো কাজে দেবেনা। SWOT Analysis এর মাধ্যমে তুমি স্পষ্ট ধারণা পাবে,   নিয়ে তুমি তোমার ক্যারিয়ার -এ এগুতে চাও। SWOT চারটি ইংরেজি শব্দের প্রথম অক্ষর দিয়ে বানানো।
S- Strength
W- Weakness
O- Opportunities
T- Threats

  . Strength- এর সাথে আসে Opportunity। পরখ করে বুঝে

নাও, তোমার Strength কোথায়। সেই জায়গায়

Opportunities কী কী, সেগুলো বিবেচনা করে দেখো।

  . Weakness- এর সাথে আসে Threat। পছন্দের বিষয় নিয়ে

পড়লেও কিছু ক্ষেত্রে তো বিড়ম্বনার সৃষ্টি হবেই। সেগুলোও

বিবেচনা করে দেখো।

SOWT -কে নির্ধারণের জন্য সহজ একটি ক্যারিয়ার শিক্ষা হিসেবে কাজে লাগাতে পারো। বিজ্ঞান ভালো না লাগলে, ব্যবসায় শিক্ষার বইগুলো ঘেঁটে দেখো। খুব কঠিন মনে হচ্ছে? মানবিকের বইগুলো পড়ে দেখো। কোনো না কোনো কিছু তো ভালো লেগেই যাবে। অনুরোধ থাকবে এই, কারো মতামত দ্বারা তোমার সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত হতে দিও না।

প্ল্যানিং শুরু করো মাধ্যমিক থেকেই

ক্যারিয়ার প্ল্যানিং শুরু করা উচিত মাধ্যমিক বা তারও আগে থেকে। তখন থেকে রিসার্চ করা উচিত কোন ফিল্ডের ডিমান্ড ৪-৫ বছর পর অনেক ভাল থাকবে, সে ফিল্ডে যে কাজ করতে হবে, সেসব কাজে আগ্রহ আছে কিনা, কাজগুলো পছন্দ কিনা। তারপর ভাবতে হবে সে কাজ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেও কিছু শেখানো হচ্ছে কিনা, সে কাজ করতে হলে কী কী শেখা দরকার তা শিখতে হবে।

  • Save

 

আয়ের দিকটাও মাথায় রাখা জরুরি

ক্যারিয়ার বলতেই আমরা অর্থ উপার্জনের মাধ্যমকে বুঝি। লেখাপড়া শেষ করে একটা ভাল বেতনের চাকরি পেতে হবে, এটাই অনেকের এক মাত্র ভিশন। যদিও ক্যারিয়ার নির্বাচনে সবচেয়ে জরুরি বিষয় এটি নয়, তবে দায়বদ্ধতার কারণে এটা আগে ভাবতে হয়।  যে ফিল্ডগুলোর ডিমান্ড ৪-৫ বছর পরেও বাড়বে, সেগুলোর দিকে নজর দেয়া উচিত হবে। এটা জানার জন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন খবর, প্রতিবেদন পড়তে হবে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণগুলো খুঁজে পড়তে হবে।

সিদ্ধান্ত নেবার আগে সময় নাও

তোমার ভালো লাগাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দাও। কোন বিষয় পড়ে তুমি আনন্দ পাও সেটা আবিষ্কার করে সেই দিকে ধাবিত হও। তোমার মন যেদিকে, সেদিকেই তোমার গন্তব্য হওয়া উচিত। লক্ষ্য নির্বাচনের আগে প্রয়োজনে সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। কিন্তু, সিদ্ধান্ত নেবার পর দ্বিধায় ভুগবে না। সিদ্ধান্তে দ্বিধা ঢুকে গেলে, এই দ্বিধাই তোমাকে আরও ভুল সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাবে। তাই লক্ষ্যে অবিচল থাকার জন্য, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভালো।

৩। নিজের ইচ্ছা বনাম মা-বাবার স্বপ্ন

নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে, বাবা-মায়ের মতামতকেও বিবেচনা করে দেখো। সবসময় মনে রাখবে, তাঁরা কখনোই তোমার খারাপ চান না। যেহেতু জীবন ও জগত নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা বেশি, তাই তাঁদের মতামতকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করো। তাঁদের স্বপ্নগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা করতেই পারো। তবে, অবশ্যই নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে না। নিজের মনের বিরুদ্ধে কাজ করে তুমি কোনদিনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না। মা-বাবার সাথে মতের অমিল হতেই পারে। এক্ষেত্রে তুমি যা করতে পারো যে, মা-বাবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেষ্টা করো।

দুজনের সাথে সম্ভব না হলে, অন্তত একজনের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারো যিনি তোমাকে বুঝতে পারবেন।  বাবা মায়ের দুজনকে নিরাশ করে ক্যারিয়ার নিয়ে শান্তিতে এগোতে পারবে না। তাই চেষ্টা করো তাদের মধ্যে অন্তত একজনকে বন্ধু বানাতে। সবকিছু শেয়ার করো। মাঝেমধ্যে একসাথে খেতে যাও, ঘুরতে যাও। আনন্দের মূহুর্ত গুলোতেই নিজেকে তাদের সামনে প্রকাশ করো। তোমার ভালো লাগা-খারাপ লাগার কথা জানাও। তোমার পছন্দের বিষয় এবং পছন্দের ক্যারিয়ার কি- এটা নিয়েও আলাপ করো। ইতিবাচক দিক গুলো গল্পচ্ছলে তুলে ধরো।

আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যপারটা তোমার কাছে ভীষণ কঠিন মনে হতেই পারে। কিন্তু বাবা-মায়ের সাথে তোমার ভালো সম্পর্ক শুধু তোমার ক্যারিয়ার সিদ্ধান্ত না, জীবনের সবকিছুকেই অনেক সহজ আর সুন্দর করে দিচ্ছে!

৪। চাকুরি আর ক্যারিয়ার কিন্তু এক না!

হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া আমাদের অধিকাংশের ক্যারিয়ার প্ল্যানেই চাকুরি থাকে। যদিও, চাকুরি আর ক্যারিয়ার এক জিনিস না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার এসব ছাড়াও অনেক ক্যারিয়ার পথ আছে, যাতে অনেকেই সফল হচ্ছে। যেমন: ফটোগ্রাফি, ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, মেক-আপ আর্টিস্ট, স্টাইলিস্ট, ক্যারিয়ার গ্রুমিং, কর্পোরেট ট্রেইনার, পাবলিক স্পিকার, ফ্যাশন ডিজাইনিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ফিল্ম মেকিং, ব্লগিং ইত্যাদি। এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার খুব একটা সুযোগ বাংলাদেশে নেই, তবে এসব বিষয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষার চেয়েও ব্যবহারিক বা প্র্যাকটিকালি শেখার প্রয়োজন খুব বেশি হয়। এগুলো বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় পেশা হয়ে উঠছে দিন দিন।

ক্যারিয়ার কি জিজ্ঞেস করলেই দশ জনের আট জন  হয়তো বলবে চাকুরী।  কিন্তু চাকুরী আর ক্যারিয়ার মোটেই এক জিনিস না। শিক্ষাজীবনে আমাদেরকে খুব কমই জানানো হয় যে ক্যারিয়ার শিক্ষা মাত্রই চাকরি খোঁজা নয়।

উদ্যোক্তা হওয়া বর্তমানে জনপ্রিয় একটি ক্যারিয়ার গোল। হলে নিজের কাজের স্বাধীনতা যেমন থাকে, তেমনি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের মত দেশ, যেখানে ৪৭% শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার, সেখানে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে তরুণদের প্রতিষ্ঠা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ’ থেকে হাজার খানেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে কাজ করার সুযোগ পায়।

৫।চাকুরির আগেই  ক্যারিয়ার হোক এর অভিজ্ঞতা।

চাকরির আগেই সংশ্লিষ্ট ক্যারিয়ার শিক্ষা খুব জরুরি। এই কাজের সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এতে এক সাথে দু’টো কাজ হয়, একে তো চাকরির জন্য রেজ্যুমে ভারি করার এক্সপেরিয়েন্স পাবে, সাথে তোমার নির্বাচিত ক্যারিয়ার পথটি আসলেই তোমার জন্য কিনা তা বুঝতে পারবে।

কাজ করার মাধ্যমে বুঝে ফেলতে পারবে তুমি এ কাজে আনন্দ পাচ্ছো কিনা, নাকি পরিবর্তনের সময় এখনই!

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে পার্ট টাইম কাজ করো। যে দিন থেকে কাজে লেগে পড়বে, মনে রাখবে ওই দিন থেকেই ক্যারিয়ার শুরু। এটা আজীবন তোমার মোট অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে রাখবে। যে কোন পণ্য এক জায়গা থেকে কিনে আরেকজনের কাছে বিক্রি করার কৌশল, কথা বলার কৌশল, টাকা উপার্জনের কৌশল ছাত্রজীবন থেকে জানা থাকলে কর্ম জীবনটা এমনিতেই সোজা হয়ে যাবে।

প্রতি সেমিস্টার শেষ হলে একটা প্রতিষ্ঠানে কাজে লেগে পড়ো। কপি পেস্ট রিপোর্ট দিয়ে ইন্টার্ন না, কমপক্ষে ৫-৭ টা কোম্পানিতে কাজ করো বন্ধগুলোতে। গ্রাজুয়েশনের আগে এক্সপেরিয়েন্স খুব জরুরী।

·          টাকা না, কাজ শিখতে প্রথমে কাজ করো:

ক্যারিয়ার কি শুধু টাকার জন্য? উত্তর হ্যাঁ অথবা না দুটোই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতেই টাকার কথা মাথায় আনা যাবেনা। কাজে আসবে, অথবা খুবই পছন্দের- এমন কাজ শেখো। প্রথমেই টাকার কথা মাথায় না এনে কাজ করে দেখাও। কোন একদিন কেউ হয়তো তোমার কাজে খুশি হয়ে প্রথমে ৫০০০ টাকা দিবে। তখন থেকে শুরু হবে তোমার অর্জন। পরের যে কোন কাজে বলতে পারবে, আগে যার ওখানে কাজ করেছো, তিনি ৫০০০ টাকা দিয়েছেন। সে দেবে ৬০০০ টাকা। এভাবেই দাম বাড়ে। যে কাজই করবে – পরিশ্রম করবে, সততার ভালোবেসে করবে, আর টাকার কথা মাথায় না এনে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে করবে, তাহলেই ভালো ফল পাবে।

মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় কেবলই তার কাজ দিয়ে।

·         পছন্দের ক্যারিয়ার নিয়ে পড়াশোনা করো:

স্টুডেন্ট লাইফে জব করে অনেকে বিজনেসের লাইন ঘাট বের করে ফেলতে পারে, তুমি তেমন করতে পারলে গ্রাজুয়েশন শেষ করে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। ট্রেনিং করা ও বই পড়াকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলো। এই খাতে বিনিয়োগ যতো বাড়াবে, ততো জীবন সহজ হয়ে যাবে।

প্রশ্ন আসতে পারে, কী কী নিয়ে পড়াশোনা করবো? এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারার দক্ষতাটুকু অবশ্যই থাকতে হবে। সেই সাথে তুমি যে ফিল্ডে কাজ করতে চাও তার সাথে সম্পৃক্ত প্রশিক্ষণ করে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারো। আর, প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস করো। যে কোন বই পড়ো, পড়তে তোমাকে হবেই- এই কথা মাথায় রেখে এগুতে হবে।

  • Save