হোম আন্তর্জাতিক ট্রাম্পের ভারত সফর: বাণিজ্য নাকি চীন ফ্যাক্টর?

ট্রাম্পের ভারত সফর: বাণিজ্য নাকি চীন ফ্যাক্টর?

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এলেন এমন এক সময়ে যখন ভারতের অর্থনীতি কিছুটা চাপের মুখে এবং বেকারত্বের হারও অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এছাড়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে লাগাতার বিক্ষোভ এবং কাশ্মীর ইস্যুতে দেশে-বিদেশে সমালোচিত হচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

শুধু ভারতেই নয়—গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্পের এটি প্রথম সফর। ষষ্ঠ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত সফর করলেন তিনি। এর আগে ২০১৬ সালে বারাক ওবামা ভারত সফর করেছিলেন। তখনও ক্ষমতায় ছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার।

ভারত সফর নিয়ে উচ্ছ্বসিত ট্রাম্প তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরেই টুইট করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘আমাদের মাননীয় অতিথির অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটা একটা বিশেষ গুরত্বপূর্ণ সফর। এই সফর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বকে আরো মজবুত করবে।’

এদিকে ট্রাম্পের ভারত সফরের মধ্যেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে মঙ্গলবারও (২৫ ফেব্রুয়ারি) নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজধানী দিল্লি। সকালে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ওই সংঘর্ষের জেরে সাত জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হয়েছে।

ট্রাম্পের সফরের বিষয়ে ভারতীয় কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তাদের গণমাধ্যমকে বলছেন, ‘এই সফরকে ঘিরে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা হল বাণিজ্য চুক্তি। গত কয়েক বছর ধরেই বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই দুই দেশ।’

তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা। তারা প্রশ্ন তুলছেন— ‘ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাবস্থা বিরাজকালে ট্রাম্পের ভারত সফর নিয়ে চলছে নানা জল্পনা ও কল্পনা। এটা কী উপসাগরীয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন মেরুকরণের আভাস?’

তবে ভিন্ন প্রশ্নও আছে— ‘চীনের যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তৈরি হতে পারে কি-না সেটা ভাববার বিষয়। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প মোদির ভারতকে ভালো বন্ধু হিসেবে পেতেই পারেন।’

ট্রাম্পের রাজনৈতিক ব্র্যান্ড হলো চীনের প্রতি কঠোর হওয়া, বিশেষ করে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে বেশ উদ্বেগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের। চীন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য বিরোধের প্রভাব পড়েছে ভারতের অর্থনীতিতেও। কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেশি ঘনিষ্ঠতা হলে সেটি ভারতকে হিসেবের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের ইন্ডিয়া প্রজেক্টের ডিরেক্টর তানভি মাদন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এ সফর তাকে (মোদি) রাজনৈতিকভাবে চাঙ্গা করবে এবং তার জন্য ভালো সংবাদ তৈরি করবে। তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির পাশে দেখা যাবে।’

ট্রাম্পের এই সফরকে কেউ কেউ ভারতীয় আমেরিকান ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৫ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক আছেন এবং দেশটির রাজনীতিতে ভারতীয়রা একটি ক্রম বর্ধিষ্ণু শক্তি হিসেবে বেড়ে উঠছে। সাধারণত তারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ট্রাম্পের এই সফরকে নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। এর মধ্যে ট্রাম্প তার ভারত সফর শুরু করার আগে গত বছরের জুনে ভারত বাণিজ্যে যে জিএসপি সুবিধা পেত, তা বাতিল করে দিয়েছিলেন, যা ভারতে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র অনুন্নত দেশগুলোকে তাদের রফতানি পণ্যে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ভারত বর্তমানে আর অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সারিতে নেই। ভারত ধীরে ধীরে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতির দেশ ভারতের জিডিপি সাধারণ হিসেবে ২ দশমিক ৯৪ ট্রিলিয়ন ডলার আর ক্রয়ক্ষমতার হিসাবে-পিপিপিতে এর পরিমাণ ১০ দশমিক ৫১ ট্রিলিয়ন। সুতরাং ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত যে ট্যারিফ সুবিধা পেত, তা বাতিল করে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন একটি বার্তা দিয়েছিলেন তারা কী চান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এও বলেছিলেন যে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। সেই থেকে অর্থাৎ গত বছরের জুন থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য এক ধরনের ‘অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা’র মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে স্পষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। দিল্লি চায় ভারতীয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করুক ওয়াশিংটন। বিনাশুল্কে মার্কিন বাজারে নির্দিষ্ট কিছু ভারতীয় পণ্যকে ঢুকতে দেওয়া হোক।

অন্যদিকে কৃষিজাতপণ্য ও চিকিৎসা যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ডিজিটাল পণ্যসহ তাদের একাধিক পণ্য থেকে ভারত শুল্ক প্রত্যাহার করুক এমনটাই দাবি তাদের। ট্রাম্প এর আগে প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছিলেন যে, মার্কিন বাজারে ভারত বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও, ভারতীয় বাজারে মার্কিন পণ্যকে শুল্কছাড় দেওয়া হয় না। বড় ধরনের বাণিজ্যচুক্তি নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প।

প্রথমবার ভারতে সফরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুশি করতে যথাসাধ্য সবকিছুই করেছে নরেন্দ্র মোদি। গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজন করেন এক অনুষ্ঠানের। এখানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় সিক্ত হন ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। এমনকি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন ট্রাম্পকন্যা ইভাঙ্কা ও তার স্বামী জেরেড কুশনার।

স্টেডিয়ামে আয়োজিত ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন ট্রাম্প। তিনি তার ভাষণ শুরুও করেন ‘নমস্তে’ বলেই।

ট্রাম্প তার ভাষণে সন্ত্রাস দমনে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমন এবং জঙ্গি মতাদর্শের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ কারণেই পাকিস্তান সীমান্তে পরিচালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় তার প্রশাসন ইসলামাবাদের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আট হাজার মাইল পেরিয়ে এখানে এসেছি একটা বার্তা দিতে, তা হল ভারত ও ভারতবাসীকে ভালোবাসে যুক্তরাষ্ট্র। এমন সুন্দর একটা স্টেডিয়ামে আপনাদের মাঝে এসে আমি খুব আনন্দিত। ভারতকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন চা-ওয়ালা। সেই চা-ওয়ালা বন্ধু নরেন্দ্র মোদির জন্য আমি গর্বিত। মোদিকে সবাই ভালোবাসে।’

নিজের বক্তব্যে অখণ্ড ভারত প্রসঙ্গও তুলে ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘ভারত এমন একটি দেশ, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ পাশাপাশি বাস করে। ভারত একটি মহান দেশ’

স্টেডিয়ামের মঞ্চ থেকেই ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র চুক্তির কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ভারতের সেনাবাহিনীকে মজবুত করতে সব রকম চেষ্টা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণেই ভারতকে অত্যাধুনিক সেনা হেলিকপ্টার সরবরাহ করা হবে। এতে ভারতীয় সেনা আরও বেশি শক্তিশালী হবে।

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ট্রাম্পের সফরের দ্বিতীয় দিনে দুই দেশের মধ্যে ৩০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে আরও তিনটি অনু-সমঝোতা সই হয়। বাণিজ্য চুক্তি যে এই সফরে অধরা থাকছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা আগেই জানিয়েছিলেন।

দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে যৌথ বিবৃতিতে নরেন্দ্র মোদিকে পাশে নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘সার্বিক বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে দুই দেশ অনেকটাই এগিয়েছে। আমি আশাবাদী, আগামী দিনে দুই দেশের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তি আমরা করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘গত চার বছরের শাসনে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ৬০ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চমানের মার্কিন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির (এনার্জি) রপ্তানি বেড়েছে ৫০০ গুণ।’

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র—কারো সাথে কারো তুলনা না চললেও এক জায়গায় দুদেশরই খুব মিল-উভয় দেশেরই প্রতিপক্ষ চীন। দ্বিতীয় অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র চীন যেনো টপকে উপরে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ভারত চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে দুদেশের মধ্যে বনিবনাও খুব একটা ভালো না। অতএব চীনকে কোণঠাসা করে রাখতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই হাঁটতে চাইবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।