১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী ভাষণের স্মারক হিসেবে দিনটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির আগেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বৈশ্বিকভাবে একাডেমিক স্বীকৃতিও অর্জন করে নেয়। এবার পেলো জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্পদ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ওই বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি’ (আইএসি)। ওইদিন প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এ সংক্রান্ত ঘোষণাটি দেন। বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণার’ স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে প্রায় ৯ বছর ।
প্রসঙ্গত, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির আগেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বৈশ্বিকভাবে একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ২২৩ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস- দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’ নামের ওই গ্রন্থ সংকলন করেছেন জ্যাকব এফ ফিল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ দিয়ে শুরু করা সংকলনের শেষ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি।
এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিনকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করার নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। আগামী এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ হয়েদেস এ সংক্রান্ত জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
ঐতিহাসিক ওই দিনটিকে কেন জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হবে না এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যেখানে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে কেন তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, শিক্ষা সচিব, গণপূর্ত সচিব, সংস্কৃতি সচিবকে জবাব দিতে বলা হয়। ওইদিন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর রুল জারির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন, মঞ্চটি পুনর্নির্মাণে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে কেন ঘোষণা করা হবে না- তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বশির আহমেদ ৭ মার্চকে ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা ও যে মঞ্চে বঙ্গবন্ধু এ ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই মঞ্চে তার আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করেন।
আদালতের শুনানিতে বশির আহমেদ বলেন, ‘১৯৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপ্রিম কোর্ট দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বিভিন্ন আদেশ দিয়েছেন। এ কারণে আমি এ রিট দায়ের করেছি। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে স্থানে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে মঞ্চ নির্মাণ করতে হবে।’
সাড়ে চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সাত কোটি বাঙালিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার ওই ভাষণের ১৮ দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের ৭৭টি ঐতিহাসিক নথি ও প্রামাণ্য দলিলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করেছে ইউনেস্কো।