আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি; পিলখানা হত্যা দিবস। এইদিন পিলখানায় জাতির ৫৭ জন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করা হয় । ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৯,সকাল ৯:৩০ মিনিটে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হয়।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের একাদশ বার্ষিকীতে এসে হত্যামামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম।
এক দশক আগে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে বিদ্রোহের মধ্যে পিলখানায় অর্ধ শতাধিক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মামলার উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় রায় প্রকাশ পায় গত ৮ জানুয়ারি। ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে দেওয়া রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়।
২০১৭ সালে দেওয়া রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে হাই কোর্ট। ১৮৫ জনকে হাই কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়, তিন থেকে ১০ বছরের সাজা দেয় ২২৮ জনকে। রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা।
এ বছর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও উচ্চ আদালতের ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি তোলার খরচ, অনুলিপি পাওয়ার প্রক্রিয়া, আপিলের পেপারবুক তৈরি, আদালতে সেই পেপারবুক রাখার স্থান, চূড়ান্ত বিচারের সময়সহ বিচারিক প্রক্রিয়ার নানাদিক নিয়েই আশঙ্কা অ্যাটর্নি জেনারেলের। তিনি বলেন, “এখন এমন একটা অবস্থার তৈরি হয়েছে, আমার মনে হয় একটা ডেডলক সৃষ্টি হয়ে যাবে।” মাহবুবে আলম বলেন, “হাই কোর্টের রায় হল ২৯ হাজার ৫৯ পাতা। কেউ যদি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প লাগিয়ে এই রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি নিতে চায়, তাহলে প্রতি অনুলিপিতে নিতে লাগবে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৫৫৪ টাকা। আর ফলিও পেপারে প্রত্যায়িত অনুলিপি নিতে হলে অনেক বেশি লাগবে।
“এখন পর্যন্ত প্রত্যায়িত অনুলিপির জন্য (সার্টিফায়েড কপি) দরখাস্ত করেছে ৩২৬ জন। এখন এমন একটা অবস্থার তৈরি হয়েছে আমার মনে হয় এতে একটা ডেডলক সৃষ্টি হয়ে যাবে। তার কারণ ফাঁসির আসামিই হল ১৩৯ জন, যাবজ্জীবন পাওয়া আসামি আরও ১৮৫ জন।
“এটা বিশাল একটা কর্মযজ্ঞ এবং সময়ের বিষয়! তাছাড়া ফাঁসি ও যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিসহ অন্যান্য আসামি যারা আছেন তাদের পক্ষে এই টাকা ব্যায় করা সম্ভব হবে কিনা এটা একটা চিন্তার বিষয়! তবে এ সবের সমাধান চাইতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন মাহবুবে আলম।
“এই ব্যাপারে আমি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব। আমি সময় করে উনার কথা বলব যে এটার সমাধান কিভাবে করা যায়?”
হাই কোর্টের রায়ে অভিযোগ থেকে খালাস পান মোট ২৮৮ আসামি। অভিযুক্ত ৮৪৬ জন আসামির মধ্যে বাকি ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
এক প্রশ্নে মাহবুবে আলম জানান, হাই কোর্টের রায়ে যেসব আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে বিজিবির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র আপিল করা হবে।
“পেপারবুক দেখে যদি মনে হয় খালাস দেওয়াটা সঠিক হয়নি, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র আপিল করবে।”
রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল করতে না পারলে বিলম্বের কারণ উল্লেখ করে আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে পারে সংশ্লিষ্ট পক্ষ।
এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে আসামি পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, “এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার জন্য কতটা সময় প্রয়োজন হবে, তা এই মুহূর্তে বলা যায় না।” বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে প্রায় ৩০০ আসামির পক্ষে লড়েছেন এ আইনজীবী।
তিনি বলেন, “২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার পরপরই নকলের জন্য হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দরখাস্ত দিয়ে রেখেছিলাম। পূর্ণাঙ্গ রায়টি এতদিন প্রকাশ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তারা তা দিতে পারেনি। গত ৮ জানুয়ারি রায় প্রকাশ হওয়ার পরে আমরা জানলাম এটা ২৯ হাজার ৫৯ পুষ্ঠার রায়।
“ফলিও কাগজে (রায়ের অনুলিপি দেওয়ার বিশেষ কাগজ) স্ট্যাম্পসহ যদি এর প্রত্যায়িত অনুলিপি দিতে হয় তাহলে রায়ের পৃষ্ঠা বেড়ে দাড়াবে ৬০ হাজার পৃষ্ঠাতে। তার কারণ হল, এখন নীল কাগজে রায়টা আছে। এই নীল কাগজের এক পৃষ্ঠায় ১৮টা লাইন ধরে। এটা যখন ফলিও কাগজে হবে তখন বড়জোর ৬-৭ লাইনের বেশি ধরবে না। সে হিসাবে ৬০ হাজার পৃষ্ঠায় গিয়ে ঠেকবে।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে বিদ্রোহে সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা। রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহে বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জওয়ানদের বিদ্রোহ। ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদণ্ড হয়। বিদ্রোহের বিচারের পর পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার শুরু হয় সাধারণ আদালতে। রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নাম বদলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হয়।