মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলতেন ” রাজনীতি শিখতে হলে এসো আমার কাছে আর ধর্ম শিখতে হলে যাও এনায়েতপুরে”
আজ পহেলা মার্চ শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জের বিশ্বশান্তি মঞ্জিল, এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা, আধ্যত্মিক সাধক, ওলিয়ে কামেল হযরত শাহ্ সূফী খাজা মোহাম্মদ ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী নকশেবন্দী মুজাদ্দেদী (রহঃ)’র ১০৭তম বাৎসরিক ওরশ ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের মধ্যে দিয়ে শুরু হচ্ছে।
আজ বাদ জোহর মাজার শরীফ জিয়ারত ও লাল ত্রিকোণা কাপড়ের উপর সাদা আরবি হরফে ‘আল্লাহ আকবার’ লেখা খচিত লাল নিশান উড়িয়ে ৩দিনব্যাপী ওরশ শরীফের শুভ সূচনা করবেন দরবারের বর্তমান গদ্দিনশীন ও খাজা হুজুরের আওলাদ হযরত খাজা কামাল উদ্দিন নুহু মিয়া। আগামী ১৮ ফাল্গুন মোতাবেক ৩ মার্চ সকালে আখেরী মুনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দেশ বিদেশ থেকে আগত লাখো আশেক প্রেমিকদের এই চাঁদের মেলা। বিশ্ব মানবতার মঙ্গল কামনা করে আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করবেন দরবার শরীফের বর্তমান গদ্দিনিশীন হুজুরপাক ।
এ উপলক্ষে গত ২/৩ মাস আগে থেকেই চলছে নানারকম প্রস্তুতি। নির্মিত হয়েছে অসংখ্য দৃষ্টি নন্দন তোরণ, করা হয়েছে বর্ণিল আলোকসজ্জা। রাতভর নানান রঙয়ের আলোর ঝলকানিতে মুখোরিত সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ এনায়েতপুর। ৩/৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রাস্তাঘাটসহ যমুনার পাড় সাজানো হয়েছে অপরুপ সাজে। মাথার উপরে টিপটিপ বাতির আলোর ছাতায় মুগ্ধ সবাই।
ওরশের ৮/১০ দিন আগে থেকেই সারাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ভারতের কলিকাতা, আসাম থেকে উপস্থিত হয়েছেন লাখো জাকের, ভক্ত, আশেক। দেশের বৃহৎ ধর্মীয় এই মহাসমাবেশ সফল করতে জেলা প্রশাসন নিরাপত্তায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি দরবার কর্তৃপক্ষ আগত লাখ লাখ ভক্ত এবং সকল অতিথিদের থাকা-খাওয়া ও ওজু গোসলের জন্য গ্রহণ করেছে বিশেষ ব্যবস্থা।
জানা যায়, আধ্যাত্বিক সুফী সাধক হযরত খাজা শাহ্ মোহাম্মাদ ইউনুছ আলী (রঃ) এঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্যই তাদের আগমন । তাঁর পঞ্চম পুর্বপুরুষ হযরত শাহ দায়েম (রঃ) ইয়েমেন থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন। ভারতের প্রখ্যাত ওলিয়ে কামেল নকশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরিকার উজ্জল নক্ষত্র আওলাদে রাসুল সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (রঃ) কর্তৃক শান্তির ধর্ম ও সুফীবাদের দর্শন ভারতের আসামসহ সারাবাংলায় প্রচারে খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) খেলাফত প্রাপ্ত হন। কিছুদিন অতিবাহিত হলে নিজ ভুম সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে খানকা স্থাপন করে শুরু করেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দরূদ) এর তরিকা প্রচার ও সুফীবাদের বাণী প্রচারের কাজ । ১৯১৬ সালে প্রথমবার হযরত খাজা শাহ্ মোহাম্মাদ ইউনুছ আলী (রঃ) স্বল্প পরিসরে কয়েকশ অনুসারী নিয়ে এনায়েতপুরে শুরু করেন এই বাৎসরিক ওরশ শরীফ। সেই ধারাবাহিকতা এখনো জারি আছে।
বিগত বছরের ন্যায় এবার ওরশ শরীফ উপলক্ষে খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এনায়েতপুর-সিরাজগঞ্জ সড়কে করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন তোরণ ও দরবারে প্রবেশ মুখে ৩ কিলোমটার জুড়ে আলোকসজ্জা। ওজু-গোসলের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, খাবার মাঠ সংস্কার, লাখ-লাখ জাকেরদের থাকা-খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা। এখানে ৩ দিনে প্রায় ২০ ঘণ্টাই খাবারের আয়োজনে ৫ শতাধিক বাবুর্চি স্বেচ্ছাশ্রমে রান্নার কাজে নিয়োজিত থাকবে। খাবার পরিবেশনে অর্ধ লক্ষাধিক মাটির থালার সানকি প্রস্তুত রাখা হয়েছে । আশা প্রকাশ করা হচ্ছে, এবছর রেকর্ড সংখ্যক প্রায় ১০ লক্ষাধিক ভক্তবৃদ্ধের আগমন ঘটবে ।
করোনাকালীন সতর্কতা অবলম্বনে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুসারীদের মধ্যে নারী, বৃদ্ধ, শিশু ও অসুস্থ্ জাকেরদের অনুষ্ঠানে না আসার জন্য আয়োজকরা নিদের্শ দিয়েছেন। এছাড়া কর্তৃপক্ষ বিশ্ব শান্তি মঞ্জিল এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফের ৫টি প্রবেশ পথ থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কারের পর প্রত্যেক ভক্তদের মাঝে বিতরণ করবে ফেসিয়াল মাস্ক।
উল্লেখ্য, খাজা শাহ্ মোহাম্মাদ ইউনুছ আলী (রঃ) এর সংস্পর্শে এসে এবং আল্লাহ্ ও রাসুল প্রেমের অমিয় সুধা পানে ধন্য হয়েছেন বাংলা ভারতের কোটি কোটি মানুষ। উনার সোহবতে থেকে তাসাউফ চর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেদের বিলীন করে অনেকেই অলি আউলিয়ার মাকাম হাছিল করছেন। ভারত- বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের দাওয়াত ও শান্তি স্থাপনের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর অসংখ্য খাদেম। ভারতের আসামের দরবার, ফরিদপুরের প্রখ্যাত আটরশি পাক দরবার ও চন্দ্র পাড়ার পাক দরবার, টাঙ্গাইলের প্যারাডাইস পাড়া, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের পাক দরবার শরীফসহ প্রায় ১২শ দরবার খানকা আজ এই নেসবতের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ্র হাবীব রাসুল (দরূদ) এঁর সত্য তরিকায় ইসলাম প্রচার ও সূফীবাদ তথা তাসাউফ চর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি মানবিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান থাকার কারণে ভারত-বাংলায় তার কোটি কোটি ভক্ত সৃষ্টি হয়েছে। এ সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে মজলুম জননেতা খ্যাত, লাল মওলানা হিসেবে পরিচিত, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (রঃ) প্রায়শই এনায়েতপুরী পীর সাহেবের নিকট যেতেন এবং নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলতেন ”রাজনীতি শিখতে হলে এসো আমার কাছে আর ধর্ম শিখতে হলে যাও এনায়েতপুরে”।
খাজা ইউনুছ আলী (রঃ) বাংলা ১৩৫৮ সনের ১৮ ফাল্গুন ইন্তেকাল করেন। দরবার শরীফের মসজিদ কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পাশে উনার মাযার শরীফ অবস্থিত। আজো দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ অফুরন্ত ফয়েজ ও বরকত হাসিলের লক্ষে মাযার শরীফ জিয়ারতে আসেন এবং আল্লাহ্র ওলির খাতিরে তাদের নানা মানত ও মনস্কামনা আল্লাহ্ পূরণ করে থাকেন।