হোম তথ্যপ্রযুক্তি হাতের মুঠোয় খুলনায় ডিজিটাল ভূমি সেবা

হাতের মুঠোয় খুলনায় ডিজিটাল ভূমি সেবা

খুলনায় ডিজিটাল ভূমি সেবা

ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও দীর্ঘসূত্রীতা দূর করতে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা জনজীবনে এনেছে স্বস্তি। খুলনায় ‘হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা’ কর্মসূচির মাধ্যমে জেলার সাধারণ মানুষ ‘দ্রুত হয়রানিমুক্ত’ এ ধরনের ভূমি সংক্রান্ত সেবা পাচ্ছেন । সরকারি সম্পত্তি রক্ষা, রাজস্ব আদায়, ইজারা, রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য এখন আর পুরোনো নথি খুঁজতে হবে না। জলমহালসহ ভূমি ইজারা গ্রহণের জন্য মানুষকে ছুটতে হবে না এক অফিস থেকে অন্য অফিসে। খাসজমি খুঁজে বের করতে সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও ছুটতে হবে না মাঠেঘাটে। সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনার সব সেবা একটি অ্যাপসে নিয়ে এসেছে খুলনা জেলা প্রশাসন। গত এক বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে ওয়েবসাইটে অনলাইনের মাধ্যমে চলছে ভূমি সেবা কার্যক্রম। এতে কমে গেছে অনিয়ম। রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। অনলাইনের এই সেবা সবার হাতে পৌঁছে দিতে তৈরি হয়েছে মোবাইল অ্যাপস। যার নাম ‘খুলনাএলএসএম’। ওয়েবসাইট ও অ্যাপসের মাধ্যমে ভূমি সেবা প্রদানের বিষয়টি দেশে এটিই প্রথম।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষক মোল্লা হাফিজুর রহমান এই ডিজিটাল সেবার সুফলভোগীদের একজন। বাসস’র সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমার জমির নামজারির রেকর্ড ভুল হওয়ায় গত দু’বছর ধরে আমাকে চরম ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও ভূমি অফিসে সেই ভুল সংশোধনের জন্য আমাকে বহুবার যেতে হয়েছে। আগে হাতে হাতে রেকর্ড ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় আমাকে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। সে সময়গুলো ছিল আমার জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।’ রহমান বলেন, ‘এই ভোগান্তি থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে এবছর জানুয়ারিতে খুলনা জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করি। তিনিই প্রথম আমাকে ডিজিটাল ভূমি সেবা গ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ আমাকে সকল উদ্বেগ, হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে রেহাই দিয়েছে। এজন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।’

রহমানের মতো খুলনার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ ডিজিটাল ভূমি সেবার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। সুন্দরবন সংলগ্ন দেশের প্রত্যন্ত কয়রা উপজেলার জেলে ফারুক আহমেদ বাসসকে বলেন, ২০০৯ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র কবলে পড়ে আমি আমার পৈতৃক গ্রাম দক্ষিণ বেদকাশী ছেড়েছিলাম। চার সন্তানের বাবা ফারুক বলেন, ‘আমি খুলনা শহরে গিয়েছিলাম এবং রিকশাচালক হিসেবে অনেক কষ্ট করেছি। কারণ, আমার পৈতৃক বাড়ি ঘূর্ণিঝড় আইলাতে ডুবে গিয়েছিল এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত জলাবদ্ধ ছিল। তিনি বলেন, আমি জানতে পারি সরকার আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্রদের সহায়তা দিচ্ছে। আমি বাড়ি তৈরির জন্য আমার পরিবারসহ জন্মভূমিতে ফিরে আসি। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখতে পাই যে, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আমার বাসস্থান সংলগ্ন চাষের জমিটি দখল করেছে।

তিনি আরও বলেন, আমার জমি উদ্ধারের জন্য আমি লিখিত অভিযোগ নিয়ে কয়রা উপজেলার এসি ল্যান্ড অফিসে যাই। স্থানীয় প্রশাসন ডিজিটাল জরিপের পর এক সপ্তাহের মধ্যে দখলকারীকে উচ্ছেদপূর্বক আমার জমি হস্তান্তর করে এবং আমার নথিপত্র পরীক্ষা করে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় মিউটেশন বা নামজারি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। জমি ক্রয় বা অন্য কোন উপায়ে জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে হালনাগাদ রেকর্ড সংশোধন করতে হয়। পুরনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে জমি রেকর্ড করাকে নামজারি বলে। এই কাজটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সহজে করাই হচ্ছে ই-নামজারি বা ই-মিউটেশন। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সারাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ই-নামজারি সেবা চালু করা হয়। ই-নামজারি মানুষের হয়রানি অনেকটাই দূর করেছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাহনাজ পারভীন বাসসকে জানান, ২০২০ সাল থেকে খুলনায় অনলাইনে ভূমি সংক্রান্ত সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। এখন যে কেউ ভূমি সংক্রান্ত পরিপূর্ণ তথ্য জানতে পারে এবং ইজারা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা এবং নবায়নের জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বাসসকে বলেন, জেলা প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভূমি সংক্রান্ত নানা ধরণের সেবা প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব আয় করা এবং এটি একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে আমি একটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শনে গিয়ে দেখি সরকারি রেকর্ড বইয়ের বেশ কিছু পাতা ছেঁড়া এবং কিছু পাতা হারিয়ে গেছে। তখন থেকেই ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও ছবি ব্যবহার করে একটি ডাটাবেজ তৈরি করার কাজ শুরু করি।’ ডিজিটাল ভূমি সেবার অংশ হিসেবে পরিত্যক্ত জমি, হাঁট-বাজার, জলমহাল ও ভূমি সংক্রান্ত অন্যান্য সেবা ডিজিটাল ব্যবস্থায় রূপান্তর করা হয়েছে। যা অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে। খুলনা জেলা প্রশাসক বলেন, পরীক্ষামূলক পর্যায় অতিক্রম করার পর আমরা শতভাগ সফলতা অর্জন করেছি। খুলনা জেলা প্রশাসনের সকল বিভাগের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, এসব ডিজিটাল সেবা প্রদানের উদ্যোগে ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতি-জালিয়াতি হ্রাস পেয়েছে।