ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কথা চয়নের। কিন্তু তখনই করোনার হানায় তা আর হয়ে ওঠেনি। বাড়িতে আসার পরেই পড়ে যান দীর্ঘ ছুটিতে। বাড়িতে মা, বাবা, ও ছোট দুই বোনের সংসার। বাবার ওয়ার্কশপের ও বাড়িতে তাতের ব্যবসাটাও করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে যায়।
এমতবাস্থায় চয়ন শুরু করেন অনলাইনে রেস্তোরাঁর ব্যবসা। মাত্র ২হাজার ৫শ টাকা মূলধন নিয়ে গত ডিসেম্বরে শুরু করেন গ্রাম ভিত্তিক অনলাইনে দেশী বিদেশী বাহারি খাবারের এই অনলাইন দোকান। এই উদ্যোগেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি চয়নকে। ছোট দুই বোনের সহযোগিতায় স্বপ্ন দেখছেন সফল নারী উদ্যোক্তা হবার। বাবা নাসিমুল গণি জুয়েল নিজেই খাবার সরবরাহ করে মেয়েকে দিচ্ছেন উৎসাহ। মাও সহযোগিতা করেন রান্না ও প্যাকেটিংয়ে।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাকিয়া আফরোজ চয়ন, জুলিয়া আফরোজ নয়ন ও নুসরাত জেরিন অয়ন। চয়নের উদ্যোগে দেশী বিদেশী বিভিন্ন ধরনের স্বাদের খাবার এখন অনলাইনে মিলছে উপজেলার এই গ্রামে। শহরের নামি-দামি সব খাবার খুব স্বল্প দামে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন তিন সহোদরা। মাত্র কয়েক মাস ধরে চলছে তাদের অনলাইন রেস্তোরাঁ। আর এতেই বিক্রি হচ্ছে দিনে ৩থেকে ৫হাজার টাকা। যার থেকে আয় থাকছে প্রায় অর্ধাংশ। শুধু তাই নয় এখানে পাওয়া যায় চাহিদা মতো সব খাবার। তবে অর্ডার দিতে হয় ঘণ্টা দুয়েক আগে। খাবারের মান নিয়েও প্রশংসায় ভাসছেন এই উদ্যোক্তা।
জাকিয়া আফরোজ চয়ন ডে নিউজকে বলেন, তিন বোন আর মা-বাবাকে নিয়ে আমাদের সংসার। বোনদের মধ্যে আমি সবার বড়। ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কথা। করোনার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। মেজো বোন নয়ন স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে আর ছোট বোন অয়ন ১০ম শ্রেণীতে পড়ে। চয়ন গত বছর মার্চে করোনার লকডাউনের সময় ঢাকা থেকে গ্রামে আসেন, পড়ে যান দীর্ঘ ছুটিতে।
তিনি আরও বলেন, বাবার ওয়ার্কশপের ও বাড়িতে থাকা তাতের ব্যাবসাটাও করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাবাকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেই চিন্তায় পড়েন তিন বোন। তখন হাতে নেই বড় কোনো পুঁজি। করোনার এই সময়ে গ্রামে বসে অলস সময় কাটানো মোটেই ভালো লাগছিল না তাদের। তাই চয়ন প্রথমে অনলাইনে একটি ফেসবুক পেজ খুলে সিরাজগঞ্জের তাঁতকুঞ্জে উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিস বাজারজাত করতে শুরু করেন। কিন্তু এই ব্যবসায় পুঁজির অভাবে খুব একটা আলোর মুখ দেখছিল না। তখন হঠাৎ চয়নের মাথায় আসে কীভাবে শহরের মতো গ্রামেও একটি অনলাইন রেস্তোরাঁ চালু করা যায়।
ডে নিউজ এর সঙ্গে আলাপ চারিতায় তিনি বলেন, যেহেতু গ্রামে খাবারের তেমন ভালো রেস্তোরাঁ নেই, তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানেই একটি অনলাইন রেস্তোরাঁ চালু করলে সাড়া মেলার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাইরে দোকান দিতে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন যা তাদের নেই। তাই ফেসবুক ব্যবহার করে হোম ডেলিভারির চিন্তা নির্ধারণ করা হয়।
সেই চিন্তা থেকেই অনলাইনে পোশাক ব্যবসার পাশাপাশি সেখান থেকেই মাত্র ২হাজার ৫শ টাকা নিয়ে ২০২০সালের ৮ ডিসেম্বর শুধু গ্রামের মধ্যেই খাবার সরবারাহের জন্য শুরু করেন তামাই ফুড কার্ট-টিএফসি নামের অনলাইন রেস্তোরাঁ। সে থেকে এখন পর্যন্ত আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার ও পরিবারের, বলে আমার সংবাদকে তিনি বলেন, তামাই ফুড কার্ট-টিএফসি এর উদ্যোক্তা ও স্বত্বাধিকারী জাকিয়া আফরোজ চয়ন।
বলেন, মাত্র ২হাজার ৫শ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন অনেক ভালো অবস্থা। শুধু আমার গ্রাম না দূরদূরান্ত থেকে অর্ডার আসে। মাত্র পাঁচ মাসে টিএফসি-তামাই ফুড কার্ট এখন নিজ গ্রামসহ আসপাশের এলাকার সব মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু ডেলিভারির ব্যাবস্থা না থাকার কারণে দূরের অর্ডার গুলো সরবরাহ করতে পারি না।
নিজেই এত সুন্দর করে এতো রকমারি খাবার রান্নার ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, আমার কখনও প্রফেশনালি রান্না শেখা হয়নি৷ ছোটবেলা থেকে মা’র রান্না দেখতাম ও নিজের রান্নার প্রতি ঝোঁক থেকেই রাঁধতে পছন্দ করি ৷ সেই রান্না দিয়েই আজ স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি করোনার সময়ে পুরো পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারছি। ভবিষ্যতে আরও পরিসরে কিছু করার স্বপ্নও লালন করছি।
তামাই ফুড কার্ট-টিএফসিতে বিরিয়ানি, রাইসবোল, পাস্তা, পিৎজা, বার্গার, কাচ্চি তেহারি, চিকেনফ্রাই, শর্মা, চাইনিজ খাবারসহ নানা ধরনের প্রায় ২০টি আইটেমের খাবার অর্ডার অনুযায়ী তৈরি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পিৎজা, বার্গার, রাইসবোল। পিৎজা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকায়, রাইসবোল ৯৯টাকায়, বার্গার ৯৯থেকে ১৫০টাকায়। এছাড়া সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন খাবার চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত খাবারের অর্ডার আসতে থাকে। তবে তুলনামূলক বিকেলে ও প্রতি শুক্রবারে অর্ডার বেশি হয়ে থাকে। জেলার বেশ কিছু গ্রাম ও শহর থেকে খাবারের চাহিদা আসছে। তবে জনবল ও পুজি কম হওয়ায় সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।
চয়ন আরও বলেন, গ্রামে বসে শুধু একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইন রেস্তোরাঁ চালিয়ে যে সফল হওয়া যায়, তা আসলে ভাবতেই অবাক লাগে। উদ্যোক্তা হওয়ার পর নিজেকে স্বাধীন মনে হয়। আগের জীবনটা ছিল ধরাবাঁধা।