মিয়ানমারে গত কয়েকদিন ধরেই সেনা অভ্যুত্থানের হুমকি বা আশঙ্কা নিয়ে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। সোমবার সেই গুঞ্জন সত্যি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এনডিএল-র নেত্রী অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটকের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।
ঠিক এক দশক আগে ২০১১ সালে দীর্ঘ সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশটিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, এ ঘটনায় তা আবারও মুখ থুবড়ে পড়ল। বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরুর পর ২০১৫ সালে মিয়ানমারে প্রথম জাতীয় নির্বাচন হয় এবং বড় জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। মেয়াদের পাঁচ বছরে সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেই এনএলডি দেশ পরিচালনা করেছে।
কিন্তু গোল বাধে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের ভোট ঘিরে। ওই নির্বাচনে আরও বড় জয় নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে সু চির দল এনএলডি।
সেনা সমর্থিত বিরোধী দল থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোটের ফল অস্বীকার করে নতুন নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানানো হয়। এ নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চাপা উত্তেজনা ছিল। গতকাল সোমবার নতুন সরকারের পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু এদিন ভোরেই সু চি এবং প্রেসিডেন্ট মিন্টকে আটক করে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এরপর দেশজুড়ে ঘোষণা করে এক বছরের জরুরি অবস্থা।
এদিকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের প্রথমে দিনেই অং সান সু চির সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন মন্ত্রীদের অধিকাংশই জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং বিবিসি বার্মিজ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সু চি সরকারের অন্তত ২৪ জন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন ১১ মন্ত্রীকে। নতুন মন্ত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই সেনাসমর্থিত দল ইউএসডিপির সদস্য।
জানা গেছে, ইউএসপিডির অন্যতম নেতা উনা মং লউন হয়েছেন মিয়ানমার জান্তা সরকারের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি গত নভেম্বরের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তবে জিততে পারেননি।
মিয়ানমারের এসব ঘটনা নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে বাইডেন বলেছেন, “সেনাবাহিনীর কখনোই জনগণের ইচ্ছা বা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিল করার চেষ্টা বা মুছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়।” বিবিসি জানিয়েছে, অং সান সু চিকে আটক ও সামরিক বাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এ মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সু চিকে গ্রেপ্তার করার পর মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পার হলেও তাকে কোথায় রাখা হয়েছে তা অজানাই রয়ে গেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী সু চি ও তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানানোর লক্ষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মঙ্গলবার বৈঠকে বসার কথা আছে বলে কূটনীতিকরা জানিয়েছেন।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করায় দেশটির ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) এক বিবৃতিতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেন তিনি।
একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং দেশটির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান ও নোবেল বিজয়ী অং সান সু চিকে আটক করার বিষয়টি ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে দেশের উত্তরণে প্রত্যক্ষ আক্রমণ’ বলে নিন্দা করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রায়শই একা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পদ্ধতির বিপরীতে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে মিত্রদের সঙ্গে আরও সহযোগিতার জন্য মিয়ানমারের সঙ্কটে বাইডেনের প্রতিশ্রুতির প্রথম বড় পরীক্ষা বলে মনে করা হচ্ছে।
বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, দখলকৃত ক্ষমতা ছেড়ে দিতে এবং দেশটির নেতাকর্মী ও আটককৃত কর্মকর্তাদের মুক্তি দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর চাপ দিতে হবে। এর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নিয়েছিল। সেই ওয়াদা ভঙ্গ করলে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদিত আইন এবং কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা করা দরকার। এরপর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই কঠিন সময়ে মিয়ানমারের জনগণের পাশে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
ফলে মিয়ানমারের সংকট বাইডেনের এসব প্রতিশ্রুতির জন্য বড় ধরনের একটি পরীক্ষা হয়ে এসেছে বলে মন্তব্য রয়টার্সের।
শেয়ার করুন