ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসায় উপকূলীয় এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। বুধবার (২০ মে) দুপুর পর্যন্ত ১৪ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র (এনডিআরসিসি) থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ আজ বুধবার বিকেল বা সন্ধ্যা নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলী অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এনডিআরসিসির দায়িত্বে থাকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কাজী তাসমীন আরা আজমিরী বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৩ লাখ ৬৪ হাজার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে। এটি সকালের তথ্য। উপকূলীয় এলাকার প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন, একই সঙ্গে তারা সেই তথ্যটা আমাদের দিচ্ছেন।’
তিনি বলেন,‘আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ আসার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মোট সংখ্যাটি আমরা হিসাব করার পর আরও পরে জানাতে পারব।’ এনডিআরসিসিতে দায়িত্ব পালনকারী এক কর্মী জানান, দুপুর পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে আসা মানুষের সংখ্যা ১৪ লাখ পার হয়ে গেছে।
এর আগে সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল বলেন, ‘লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে আসতেছে। এ বছর স্কুল, কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুালোকেও আশ্রয় কেন্দ্র করা হয়েছে। এখন তো বাড়ির পাশেই স্কুল, বিকেল পর্যন্ত তো লোকজন আসতে থাকবেই। আমরা চাইছি ঝুঁকিপূর্ণ ২০ লাখের মতো মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে।’
আশ্রয় কেন্দ্র ১২ হাজার ৭৮টি থেকে বাড়িয়ে ১৩ হাজার ২১৫টি করা হয়েছে বলেও জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব।
শাহ কামাল বলেন, ‘আম্ফান’ যদি সন্ধ্যার মধ্যে উপকূল অতিক্রম শুরু করে তবে আশ্রয় কেন্দ্রে আসা মানুষ হয়তো কাল সকাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর।
আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা থাকলেও সামাজিক দূরত্ব মানতে নারাজ মানুষ
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখতে বরগুনায় দ্বিগুণ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানাছেন না আশ্রয় নেয়া মানুষ। এছাড়াও আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার দেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের। তবে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাবার দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
সরেজমিনে বরগুনার পশ্চিম গোলবুনিয়া শিশু-কিশোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুই শতাধিক আশ্রয়প্রার্থী এই আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত জায়গা থাকার পরও তারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকছেন। কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না তারা।
একই চিত্র দেখা গেছে সদর উপজেলার ছোনবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পোটকাখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও।
পশ্চিম গোলবুনিয়া শিশুকিশোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত স্থানীয় অধিবাসী আলেয়া বেগম বলেন, আমাদের এই আশ্রয়কেন্দ্রে খাওয়ার জন্য গতকাল রাতে গুড়, চিড়া, পানি ও বিস্কুট দেয়া হয়েছে। এছাড়া আর কোনো খাবার দেয়া হয়নি। এখানে বৃদ্ধ ও শিশুরা রয়েছে। তাদের খাবারের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় এই কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া সবাইকে মাস্ক এবং সাবান দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ব্যাগ থেকে মাস্ক বের করে মুখে দিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরতে মনে চায় না।
একই কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া আব্দুল লতিফ বলেন, আমাদের এখানে খাবার নেই। শিশুরা না খেয়ে আছে। সংশ্লিষ্টদের দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার সরবরাহের অনুরোধ জানান তিনি।
মোসা. লিমা আক্তার বলেন, সবাইতো রোজা থাকতে পারে না। তাছাড়া বাড়ি থেকে যে খাবার রান্না করে নিয়ে আসব সে সুযোগও নেই। পানিতে বাড়িঘর সব তলিয়ে গেছে।
গোলবুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রের সহকারী শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তাছাড়া আমরাও বারবার তাদেরকে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করতে বলেছি। কিন্তু আশ্রয়প্রার্থীরা কিছুতেই আমাদের কথা শুনছেন না।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. জাফর হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপের আগেও নানা প্রচেষ্টার পরও সাধারণ মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানেনি। তারা তাদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করেছে। তাই এই দুর্যোগকালীন সময়ে তাদের স্বাস্থ্যবিধি কতটা মানানো যাবে বা তারা কতটা মানবেন সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, জেলার ৬১৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে আমরা ইতোমধ্যেই আশ্রয়প্রার্থীদের মাস্ক এবং হ্যান্ডস্যানিটাইজারসহ সাবান দিয়েছি। তাদের সামাজিক দ্রুত নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আমরা বরগুনায় দ্বিগুণ সাইক্লোন শেল্টার নির্ধারণ করেছি।
খাদ্য সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, বরগুনার প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে রোজাদার, যারা রোজা রাখেননি এবং শিশুদের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। একযোগে জেলার এক ৬১৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এসব খিচুড়ি বিতরণ করা হবে। তাই আশ্রয়প্রার্থীদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ জানান তিনি।
খাবার না দেয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়ছে মানুষ
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে লক্ষ্মীপুরে প্রশাসনের নির্দেশে উদ্ধার কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার (১৯ মে) সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জেলা সদর, রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়। কিন্তু বুধবার (২০ মে) ভোরের আলো ফুটতেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছে মানুষ। বাড়ি ফিরে যাওয়া মানুষগুলোর অভিযোগ, তাদের খাবার দেয়া হয়নি। পেটে ক্ষুধা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে বসে থাকতে রাজি নন তারা।
কমলনগর উপজেলায় কাজ করা একাধিক উদ্ধারকর্মীর তথ্য অনুযায়ী, পুরো উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ মানুষকে তারা উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। কিন্তু রাতে কাউকেই খাবার দেয়া হয়নি। যে কারণে সকাল হতেই সবাই চলে গেছেন।
কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছয়েফ উল্যাহ জানান, মতিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়া তার ইউনিয়নে আর কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। তবুও প্রায় ১৫০ জন মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। তাদেরকে শুকনো খাবারও দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভোরে সবাই আবার বাড়ি ফিরে গেছে। তার ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ রয়েছে। তিনটি ওয়ার্ড নদীতে ভেঙে যাওয়ায় তারা আশপাশের ইউনিয়নে বসবাস করছেন।
সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ ছৈয়াল জানান, মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে রাজি হচ্ছে না। তবুও গতকাল রাতে প্রায় ২০০ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। কিন্তু ভোর হতেই সবাই চলে গেছে। এই ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ রয়েছে। কিন্তু এর পরিবর্তে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ৮টি।
এদিকে জেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা রামগতি উপজেলা। এ উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন মেঘনা বেষ্টিত চর আবদুল্লাহ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রশাসনের তথ্যমতে এই ইউনিয়নে প্রায় ১৪ হাজার জনসংখ্যা রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২০০ মানুষকে মঙ্গলবার উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। বাকিরা বিভিন্নভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন।
ওই উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে। উপজেলায় ৬৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এখানে ১০১টি টিমের অধীনে ১ হাজার ৫১৫ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে।
রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল মোমিন জানান, মঙ্গলবার রাতে তিনি চরআলগি, বড়খেরিসহ ৩-৪টি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। প্রত্যেকটি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের জন্য খাবার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। মানুষকে খাবার দেয়া হয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন তিনি।
ঝুঁকিপূর্ণ চর আবদুল্লাহতে পুলিশ, কোস্টগার্ড পাঠিয়ে কিছু মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকেই প্রশাসনের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে গেছেন। তবে অধিকাংশই আত্মীয় স্বজনের বাড়িসহ নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছেন বলেও জানান তিনি।