বৈশ্বিক মহামারি করোনা: সংকটের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)  এবছরের ১১ মার্চ করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে বিশ্বমহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভাইরাসটি বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় ২ লক্ষ ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্য হয়েছে অত্যধিক ছোঁয়াচে এই রোগের কারণে। বর্তমানের এই আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা থেকে যদিও পুরোপুরি এই দুর্যোগের মাত্রা এবং এর ফলে যে বিশ্ব সংকটের সৃষ্টি হবে,তার যথাযথ চিত্র পাওয়া যাবে না। তবে এ মহামারী-পরবর্তী যে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় সংকট তৈরি হবে সে ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা একমত। প্রকৃতপক্ষে কেউই জানেন না আগামীকাল কী ঘটবে,তারপর কী হবে এবং করোনা পরবর্তী সমাজ,সরকার,স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,কৃষি,শিল্প ও সর্বোপরি আমাদের অর্থনীতির কী পরিবর্তন ঘটবে। 

বৈশ্বিক এই করোনা মহামারিতে প্রান্তিক ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্রত গতিতে অগ্রসরমান এই বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারে, যেহেতু বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ৭০ শতাংশেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় যায় যেখানে প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই করোনা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশের রফতানি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ কমে ২৬ দশমিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৭ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এমন পরিস্থিতিতে রফতানির এই নিম্নমুখী ধারা সামনের দিনগুলোয় আরো বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার এবং সরবরাহ চেইনের বড় দাতা; যা রফতানি, আমদানি ও উৎপাদনের জোগান দেয়। উৎপাদন, সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও বাজার বিপর্যয় এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান,অর্থনৈতিক বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিঘ্নিত হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পরই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হবার একটা আভাস দিয়েছিল। ইতোমধ্যে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। তবে করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণের সময় এখনো হয়নি। কেননা প্রতিদিনই নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রাক্কলন দিয়ে কেবল ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা সম্বন্ধে ধারনা করা যায়। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করবে সংক্রমণের বিস্তার, এর স্থায়িত্ব এবং নীতিনির্ধারকরা স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি উপশমে কত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন তার ওপর।

করোনা পরবর্তী বিশ্ব বাজারে কী পরিবর্তন আসে,তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এখন মার্কিন যুক্তরাষ্টের সঙ্গে চীনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশ করোনার জন্য চীনকে দায়ী করছে। এমন পরিস্থিতিতে করোনার কারণে ইউরোপের ব্যবসা চীন থেকে সরে বাংলাদেশ আসতে পারে। বিশ্বায়নের এই যুগে যেখানে বেশি লাভ হবে, ব্যবসায়ীরা সেখানেই যাবে।কিন্তু ব্যবসার সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। অনুযোগ, অভিযোগের কারণে ব্যবসার সম্পর্কে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। তবে আশার কথা হল বৈশ্বিক ঝুঁকি চলে গেলে সারাবিশ্বে অল্প মূল্যের গার্মেন্টস পণ্য কেনার চাহিদা বাড়বে। যেহেতু অনেকের আয় কমে যাবে, ফলে নিম্নমূল্যের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হবে। যেগুলোর জন্য আমাদের দেশের চাহিদা তৈরি হবে। ফলে এটি আমাদের দেশের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধকল্পে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেও দেশের বিভিন্ন বন্দরের (সমুদ্র, স্থল ও বিমান) মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে এসব এলাকায় (পোর্ট ও কাস্টমস্ এলাকা) অবস্থিত ব্যাংকের শাখা/বুথসমূহ স্থানীয় প্রশাসনসহ বন্দর বা কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনাক্রমে সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার রাখা হচ্ছে। COVID-19 এর প্রভাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ এর এমন ইঙ্গিতের বিপরীতে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বাংলাদেশের তফসিলি ব্যাংক গুলোর প্রধান কার্যালয় ও তাদের শাখা গুলো খোলা রেখে সীমিত আকারে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ৫টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ঘোষণা করেছেন তার সবকটিই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে জড়িত। এসব প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দেবে সরকার,যা জিডিপি’র প্রায় ২.৫২ শতাংশ।

প্যাকেজ-১: ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেওয়া। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণ গ্রহিতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

প্যাকেজ-২: ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান-ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণ গ্রহিতা শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

প্যাকেজ-৩: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো- ব্লক টু ব্লক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফ-এর বর্তমান সুদের হার LIBOR + ১.৫ শতাংশ (যা প্রকৃত পক্ষে ২.৭৩%) হতে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।

প্যাকেজ-৪: প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম (Pre-shipment Credit Refinance Scheme)নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।

প্যাকেজ-৫: রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ।

এই প্যাকেজসমূহ ঠিকভাবে বাস্তবায়ন গেলে দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে। অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।

করোনাভাইরাসের কারণে যখন অস্থিরতা বিরাজ করছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এমন একটা সময়ে বাংলাদেশের জন্য সুখবর দিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবি এর মতে,সারা এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে। সংস্থাটির মতে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি)প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৭.৮ শতাংশ হতে পারে। তবে সরকার চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। ২০২০ সালে এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ২ শতাংশ কমে যেতে পারে। যেখানে গত বছর গড়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি । তবে সংস্থাটির এমন অনুমানের বাস্তব চিত্র টা কি হবে এখনই ঠিক করে বলা যাচ্ছেনা।

করোনাভাইরাসের প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ার আগেই বেশ মন্দাভাব দেখা গেছে রাজস্ব আহরণে। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে। পাশাপশি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়ায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থার মধ্যেই আসে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভয়াল থাবা। বর্তমানে এ ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে বৈশ্বিক সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ভুগছে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণটাও তখন অনেক বেড়ে যাবে।

ক্রমান্বয়ে সরকারের আয় কমছে, এ পরিস্থিতিতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণায় সবার মনে প্রশ্ন, প্রণোদনার অর্থের সংস্থান কিভাবে হবে? এমন এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয় পুরো টাকাটাই আসবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। পৌনে ৭৩ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজের মধ্যে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন করবে দেশের ব্যাংকিং খাত। প্যাকেজের বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়া হবে চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০)বাজেট থেকে। পাশাপাশি প্যাকেজের ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং বাকি ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করবেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এই প্যাকেজের আওতায় দেশের বড়,মাঝারি,ক্ষুদ্র শিল্প ও সেবাসহ মৎস্য, ডেইরি,পোলট্রি খাতও তাদের চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রকাশ করেছে।এতে করে দেশের শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য, কৃষি প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রান সঞ্চার হবে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে লকডাউনে বন্ধ রয়েছে ব্যবসা। অচল হয়ে পড়ছে বিশ্ব বাণিজ্য। এতে নেতিবাচক ধারায় থাকা দেশের রফতানি আয় আরও কমেছে। অর্থবছরের শুরুতে হোঁচট খায় রফতানি আয়। এরপর থেকেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। করোনা বিশ্ব পরিস্থিতিতে আগামীতে রফতানি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর(ইপিবি) মতে, চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ৯ মাস (জুলাই-মার্চ)শেষে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮৯৭ কোটি ডলার। এই আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ কম। একক মাস হিসাবে মার্চে রফতানি আয় হয়েছে ২৭৩ কোটি ডলার,যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ কম।

বিজিএমইএর তথ্য মতে,চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ের তুলানায় ৮৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনে রফতানি হয়েছিল ১১৯ কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। আগের মাস মার্চেও রফতানিতে বড় ধাক্কা খায় পোশাক খাত। গত মার্চে ১৯৭ কোটি ২২ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়,যা গত বছরের মার্চের চেয়ে ২৬ দশমিক ৭০ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের মার্চে ২৬৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল। এদিকে পোশাক খাতের এ ভয়াবহ সংকটের মধ্যে প্রতিদিনই বাতিল হচ্ছে পোশাকের ক্রয়াদেশ। সবশেষ ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের তৈরি পোশাক খাতের এক হাজার ১৪২টি কারখানার ৯৮ কোটি পোশাক পণ্যের রফতানি আদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে। যার আর্থিক পরিমাণ ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন বা ৩১৭ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতি মুহূর্তে ক্রেতারা ক্রয় আদেশ স্থগিত করেই চলছেন।আমাদের রফতানি নেই বললেই চলে। এখন অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন বন্ধ। আগামীতে কী হবে বলা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে পোশাক খাত ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। তবে আশার কথা হল ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া গাইডলাইন মেনে সামাজিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত আকারে কিছু কিছু কারখানা উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে।

বাংলাদেশর অর্থনীতিতে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ একটি বিরাট ভূমিকা রেখে আসছে। বলা হয়ে থাকে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির নেপথ্য নায়ক ও চালিকা শক্তি। প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে বৈষম্যের শিকার হয়ে,খেয়ে না খেয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়ে সমৃদ্ধ করছেন দেশের অর্থনীতি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১৩ শতাংশ বিদেশে কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্য,ইউরোপ,এশিয়া ও আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৬১টি দেশে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ কর্মরত আছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় স্বস্তির জায়গা হচ্ছে এই প্রবাসী আয়। অথচ মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রবাসী আয় কমেছে এক হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২ শতাংশ প্রনোদনা ঘোষণার পর ১৪০ কোটি ডলারের কম রেমিট্যান্স আসেনি কোনো মাসেই। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রবাসী আয়ের অংকটা ছিল ১৪৫ কোটি ডলার। তবে মার্চে প্রবাসীদের পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

দেশের টেকসই উন্নয়নে প্রবাসী আয় বাড়ানো খুবই জরুরি। রেমিট্যান্স কমে গেলে অর্থনীতিতে আরও চাপ তৈরি হবে। গত কয়েক মাস ধরে রপ্তানি কমে গেছে। আমদানির পরিমাণটাও বেশ কিছুদিন ধরে কমছে। এমন পরিস্থিতিতে আশা জাগাচ্ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশেষ করে দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণার ফলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশের বেশি। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সে সূচকেও পতন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,২০১৯ সালের পুরো মার্চজুড়ে ১৪৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এবার ১২ মার্চ পর্যন্ত প্রথম দুই সপ্তাহে প্রবাসীরা পাঠান ৮০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। তবে মার্চ শেষে এর পরিমাণ ১২৮ কোটি ডলারে থেমেছে।

গত বছরের জুলাই থেকে রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। প্রণোদনার অর্থ পরিশোধের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফলে আগে অন্য উপায়ে অর্থ পাঠাতেন এ রকম অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন। ফলে বৈদেশিক আয়ের অন্যতম আরেক খাত রপ্তানি কমলেও রেমিট্যান্স বাড়ছিল। কিন্তু করোনার এই বৈশ্বিক মহামারিতে দেশে দেশে লকডাউন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা কাজে যেতে পারছেন না। রুমে বসে বসে অলস সময় পার করার পাশাপাশি চাকুরীচূত হবার ভয় নিয়েও দিন পারছেন কেউ কেউ। এর ফলে প্রবাসী আয় কমে এসেছে এবং এর প্রভাব আগামীতে আরও কতদিন থাকবে এখনই সেটা নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছেনা।

আমি মনে করি, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সকলকেই অনবদ্য ভূমিকা রাখতে হবে। এই ধরনের দূর্যোগ মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি খাতের নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি পলিসিগুলো ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারি,আমাদের উদ্যোক্তা, আমাদের শ্রমিকরা যদি টিকে থাকেন, তাহলে করোনা পরবর্তীতে আমাদের একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে। সুতরাং সাময়িক বিপর্যয় কীভাবে কাটানো যায়,সবাই যার যার সৃজনশীল চিন্তাধারাকে কাজে লাগাতে হবে।

লেখকঃ কৃষিবিদ ও ব্যাংকার