করোনা পরবর্তী খাদ্য সংকট মোকাবেলায় আমাদের কৃষি প্রস্তুতি

এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। এরপর থেকে একে একে আক্রান্ত রোগী আর মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় এর হার কম, তারপরও এখনই নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছেনা। ভয় নয়, সচেতনতাই জয়- এই স্লোগানই আপাতত করোনা মোকাবেলার মোক্ষম হাতিয়ার।

করোনার কারণে ধুঁকছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি। এজন্য করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতিকেও সচল রাখতে হবে। না হলে অনাহার এবং অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণে করোনার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। বৈশ্বিক এই মহামারিতে দেশের প্রায় সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ। একমাত্র কৃষিখাত এখনো টিকে আছে আশা জাগানিয়া হিসেবে। করোনা প্রতিরোধে ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিখাতকে সচল রাখতে হবে যেকোন মূল্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া গাইডলাইন মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কৃষি উৎপাদন ও তা সরবরাহ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হবে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি ৷এদের বেশির ভাগই কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে ৷ তারা রিকশা চালান,বাসাবাড়িতে কাজ করেন,দিনমজুরি করেন ৷ তারা কাজ হারাচ্ছেন ৷ দেশের বড় একটি অংশ মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। এই মানুষগুলো এমনিতেই দিন আনে দিন খায়৷ এখনতো খাবারই পাচ্ছেন না। সরকারের পাশাপাশি সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু সবাইকে যার যার সামর্থ্যানুযায়ী এগিয়ে আসলে কেউ না খেয়ে থাকবেনা।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে আপাতত ঘরে থাকা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই ৷ সে লক্ষে সরকার ২৫ মার্চ হতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর হতে কয়েক দফাতে সাধারন ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন। এই সংকটকালে ভূমিহীন শ্রমিক অথবা দিনমজুর কোটি মানুষের খাদ্য জোগান সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

করোনার প্রভাব চলে গেলেই আমাদের অর্থনীতি আবার ফুলে ফেঁপে উঠবে-এমনটা আশা করা ঠিক নয়। তখন চাহিদা বাড়বে। এটাকে বলা যেতে পারে সাময়িকভাবে সবকিছু থমকে যাওয়া। ফলে করোনার প্রভাব আগামী মাস কয়েকের মধ্যে কেটে গেলেও এর ধাক্কা সামলে নেবার ক্ষমতা খুব কম দেশেরই আছে। সেটা এত সহজে হবে কি না,তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা বড় অংশ আসে বৈদেশিক মুদ্রা হতে। এই খাতের মধ্যে আছে পোশাক ও অন্যান্য পন্যসামগ্রী রপ্তানী এবং প্রবাসীদের প্রেরিত ফরেন রেমিট্যান্স। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে আপাতত দেশের গার্মেন্টসগুলো বন্ধ রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন আমাদের প্রবাসীরা,যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি। কিন্তু করোনার এই বৈশ্বিক মহামারিতে সারাবিশ্বের মানুষ যখন গৃহবন্দী সেখানে আমাদের প্রবাসীরা এর বাইরে নয়। বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকেও আমরা অনেক পিছিয়ে যাব এটা নিশ্চিত।

“করোনার এই মহামারিতে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মুখে খাবার তুলে দেয়ার অর্থ জোগাড় করতে না পারলে অনাহারে বিশ্বের অন্তত তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান ডেভিড বিসলে এমন সতর্কবাণী আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্যথায় আমাদের ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। তবে আমরা খুব আশাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের কারণে দেশে যেন খাদ্য ঘাটতি না হয়,শুরু থেকেই বিষয়টি গুরুত্বের সহিত পর্যবেক্ষন করে আসছেন এবং সে লক্ষ্যে নানামূখী পদক্ষেপ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তার নির্দেশে ৫০ লাখ মানুষকে রেশন কার্ড দেয়া হচ্ছে। আরও ৫০ লাখ লোককে রেশন কার্ড দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

করোনা সংকটে সারাবিশ্বের ন্যায় আমাদেরও খাদ্য সংকটে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে ৷ এ অবস্থায় আমাদের কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং সেই উৎপাদন আরো বাড়ানো ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। করোনা সংকটে দেশের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তা মোকাবেলায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখার উপর জোর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৷কৃষকদের জন্য সরকার কর্তৃক ৪% হারে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল, সারে ভর্তুকি বাবদ নয় হাজার কোটি টাকা, পাশাপাশি বীজ ও চারা বিতরণে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথাও আমরা সকলেই জানি। এক্ষেত্রে কৃষিঋণের সুদ মওকুফ,বিনা সুদে /সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদান,বর্গাচাষিদের জন্য ব্যক্তি জামানতে ঋণ ও মৎস্য,হাঁসমুরগি পালন,ডিম-দুগ্ধ ইত্যাদি কৃষিনির্ভর ও কৃষি ভিত্তিক অন্যান্য খাতে সুষম বন্টনের মাধ্যমে এই প্রনোদনাকে সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকের দৌড় গোড়ায় পৌছে দিতে হবে। একটি সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সকল প্রনোদনা প্যাকেজ প্রান্তিক পর্যায়ে দেশের কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দিতে পারলে এই দূর্যোগ মোকাবেলা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে।

এ বছর হাওরে ফসল ভালো হওয়ায় কৃষকদের বুকে যে আশার সঞ্চার হয়েছে তা যেন কোনভাবেই ভেস্তে না যায়। ইতোমধ্যে সারাদেশে বোরো ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে গিয়েছে ৷ বৃষ্টি শুরু হলে হাওরে বন্যা দেখা দিতে পারে কিংবা শিলা বৃষ্টিতে আমাদের পাকা ধানের মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কায় দ্রুত ধান কেটে নেয়া আবশ্যক ৷করোনার বিস্তার রোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও জেলায় জেলায় লকডাউন চলছে। ফলে ফসল কাটার শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে ৷এই সংকট নিরসনে অন্যান্য পেশার শ্রমিকদের ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষি অধিদপ্তর ও প্রশাসন থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যা প্রশংসনীয়। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যেসব এলাকায় ধানকাটার শ্রমিকের সংকট আছে সেসব এলাকার ছাত্র-শিক্ষক সকলে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাজে নেমে পড়লে আমাদের খাবারের কোনও অভাব হবে না। জাতির ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র-শিক্ষকদের এগিয়ে আসার বহু ইতিহাস আছে এই জাতির। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীও এ ব্যাপারে দাতিয়্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে, যারা যেখানে ধান কাটতে যেতে চায় তাদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে। জেলা প্রশাসন থেকে ধান কাটতে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য সরকারি ত্রাণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে৷ যারা দূর থেকে আসবেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় তাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা টি করতে হবে।

ঘরে ধান উঠার পর কৃষক যেন এই ফসলের ন্যায্য দাম পায়,সেদিকে লক্ষ্য রেখে খাদ্য মন্ত্রণালয় গতবছরের চেয়ে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান বেশি ক্রয় করার যে ঘোষণা দিয়েছে তা সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। প্রয়োজনে এর পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।

“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতে করোনা সংকটকালীন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা করোনায় আক্রান্ত হলে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রাণিজ পুষ্টির উৎস যেমন- দুধ,ডিম,মাছ ও মাংসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। আর তাই এই সংকটকালীন সময়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে গাভী পালন থেকে শুরু করে হাস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, দুধ,ডিম ও মাংসের  নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন,পরিবহন ও বিপণন চ্যানেল টি সচল রাখার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সারা বিশ্বে ইতোমধ্যে খাদ্য দুর্ভিক্ষের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটাকে রুখতে সমাজের সবস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের কৃষক ভাইদের আরো উৎসাহিত করতে কৃষিবিদ থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা যাবেনা। টবে হোক,ছাদে হোক,মাটিতে হোক ফসল, সবজি, তরিতরকারি,ফলমূল ইত্যাদির উৎপাদন বাড়াতেই হবে। আর এটাই হবে করোনা পরবর্তী আরেকটি যুদ্ধ মোকাবেলা। যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই ইনশাল্লাহ।

লেখক:-কৃষিবিদ ও ব্যাংকার