ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ;কোথায় ছিলো, কীভাবে ফিরলো,কীভাবে ধরা পড়লো

কয়েক দিন ধরে আদালত প্রাঙ্গণে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ করে আদালত এলাকা সরব হয়ে ওঠে। করোনা ভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেও মঙ্গলবার দুপুরে পুরান ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও আইনজীবী ছাড়াও উৎসুক জনতার ভিড় জমে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন (অবঃ) আব্দুল মাজেদকে আজ ভোরে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির করা হলে তাকে দেখতেই আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় জমে। সবার প্রশ্ন কে এই মাজেদ?

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের মরহুম আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ। ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের সময় সে অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। হত্যাকাণ্ড শেষে সে বঙ্গবন্ধু হত্যার অপর আসামি মেজর শাহরিয়ারসহ অন্যান্য সেনাসদস্যদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে দায়িত্ব পালন করে। এছাড়াও সে দেশ ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ক্যূকৃত অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গভবনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। সে  হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের আদেশে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়া গমন করে। সেখানে ক্যূকৃত অফিসারদের সঙ্গে তিন মাস অবস্থান করেন। অবস্থানকালীন সময়ে হত্যাকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন সরকার তাকে সেনেগাল দূতাবাসে বদলির আদেশ দেন।

পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন সরকার ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেয় এবং উপসচিব পদে যোগদানের সুবিধার্থে সেনাবাহিনী চাকরি থেকে সে অবসর নেয়। পরবর্তীতে তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর সে মিনিস্ট্রি অফ ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টে ডাইরেক্টর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট পদের জন্য আবেদন করে এবং উক্ত পদে যোগদান করে। সেখান থেকে সে ডাইরেক্টর অফ হেড অফ ন্যাশনাল সেভিংস ডিপার্টমেন্টে বদলি হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু করলে সে আটক হওয়ার ভয়ে আত্মগোপন করেন।

গতকাল সোমবার (৬ এপ্রিল) দিবাগত রাত ৩টার সময় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর এলাকা থেকে আটক করেন। মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) দুপুরে তাকে সিএমএম আদালতে হাজির করা হলে বিজ্ঞ আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন।

গ্রেফতারকৃত আব্দুল মাজেদ চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তার স্ত্রী সালেহা বেগম বর্তমানে বাড়ি ১০/এ, রোড-১, ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকা ঢাকা সেনানিবাসে বসবাস করছেন।

কোথায় ছিলো, কীভাবে ফিরলো, কীভাবে ধরা  পড়লো মাজেদ?

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ। সোমবার (৬ এপ্রিল) মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি সংস্থা বলেছিল, সে দেশের বাইরে ছিলো। তবে কোন দেশে ছিলো, কীভাবে দেশে ফিরলো সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। এমনকি দেশের কোন বিমানবন্দর বা স্থলবন্দর দিয়ে কীভাবে দেশে ফিরেছে, এ বিষয়েও কেউ কোনো তথ্য জানাতে পারছেন না।

সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বেশ ক’বছর দেশে থাকার পর হঠাৎ দেশ ছাড়া হয়ে গাঁ ঢাকা দেয় মাজেদ। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যা’ ও ‘আসামিরা কে কোথায়’ এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হতো। ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বিভাগের কাছে মাজেদের বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল না। সরকারের কাছেও তার অবস্থা সম্পর্কে ছিলনা কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য।

২০১৯ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো এনসিবির সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সর্বশেষ তার অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানে বলে শোনা যাচ্ছিল। তখন দুই দেশকে চিঠিও দেয়া হয়। জবাবে ভারত বলেছিল, মাজেদ তাদের দেশে নেই। তবে পাকিস্তান কোনো জবাব দেয়নি।

এতোদিন কোথায় ছিল
গ্রেফতার হওয়া মাজেদ পুলিশের কাছে বলে, গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘদিন তিনি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে ছিল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ আদালতে তোলার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন মাজেদ তাকে বলেন, গ্রেফতার এড়াতে তিনি গত ২০ থেকে ২২ বছর ধরে কলকাতায় আত্মগোপনে ছিল।

কীভাবে ফিরল
আদালতে আইনজীবীর জিজ্ঞাসাবাদে কিছু না বললেও আইন-শৃঙ্খলার বাহিনী ধারণা করছে, করোনাভাইরাসের কারণে ভারত থেকে অনেককেই পুশ ব্যাক করা হয়েছে। সে কারণে সেখান থেকে ২৬ মার্চ ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকতে পারে মাজেদ। এর আগে লিবিয়া ও পাকিস্তানে আত্মগোপনে ছিল।সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। সেখান থেকে পাকিস্তানে, এরপর লিবিয়ায়। সেখান থেকে ২০১৬ সালে আবারও ভারতে ফেরে।

যেভাবে গ্রেফতার
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপ-পরিদর্শক জহিরুল হক আদালতকে জানান, সোমবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে আবদুল মাজেদকে গাবতলীতে রিকশায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তখন সন্দেহ হয় পুলিশের। এসময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মাজেদ জানায়, সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নির্মমভাবে খুন হন বিপথগামী কিছু সেনার হাতে। এরপর তার হত্যাকারীদের ফাঁসি হলেও মাজেদসহ ৬ জন দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। মাজেদ ধরা পড়ায় পলাতক বাকিরা হচ্ছে রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল রশীদ, মুসলেহউদ্দীন রিসালদার।