ইংরেজী বর্ষের চতুর্থ মাস এপ্রিল আর ফোল (FOOL) একটি ইংরেজী শব্দ, যার অর্থ বোকা। এপ্রিল ফোলের অর্থ ‘এপ্রিলের বোকা’। মুসলমান বা ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য “এপ্রিল ফোল” ইতিহাসের একটি জঘণ্যতম, ঘৃণ্য এবং হৃদয়বিদারক লোমহর্ষক ইতিহাস।
ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের যে জোয়ার ওঠে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও ৷ অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনে কায়েম হয় মুসলিম শাসন ৷ মুসলমানদের নিরলস প্রচেষ্টায় স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে ৷ দীর্ঘ ৮০০ বছর একটানা অব্যাহত থাকে এ উন্নতির ধারা ৷
হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষের দিক। যখন সারাবিশ্বে মুসলমানদের বিজয়ের বাতাস বয়ে চলছে। সে বাতাস ইউরোপের মাটিতেও দোলা দেয়। ইউরোপের একটি দেশের নাম আন্দুলুস বা বর্তমান স্পেন। ইউরোপের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত রুপসি স্পেন। উত্তরে ফ্রান্স, পশ্চিমে র্পতুগাল, র্পূবে ও দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর। স্পেনের রাজা লডারিক ছিলেন একজন কট্ররপন্থী জালিম খৃস্টান। তার জুলুমে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। তার জুলুম নির্যাতনে হাপিয়ে উঠেছিল মাজলুম মানবতা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে টু শব্দ করার সাহস ছিল না কারো।
যখন গোটা ইউরোপের ক্রান্তিকাল চলছিল, তখন ওই অঞ্চলের মুসলিম রণক্ষেত্রে প্রধান কমান্ডার ছিলেন মূসা বিন নুসায়েরদ। তিনি তখন দক্ষিণ মরেক্কো জয় করে কায়রোয়ানে অবস্থান করছিলেন। সে সময় তার সাথে কাউন্টার রাজা জুলিয়ান সাক্ষাত করে মাজলুম মানবতাকে রক্ষা করার জন্য সাহায্যের আহবান করেন। মূসা বিন নুসায়ের তার অধীনের সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে ৭,০০০ (সাত হাজার) সৈন্যর একটি মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করেন । ৯২ হিজরী ২৮ রমযান মোতাবেক ৭১১ খ্রিঃ জুলাই মাসে স্পেনে অবতরণ করেন মুজাহিদ বাহিনি। শুরু হয় খ্রিস্টানদের সাথে প্রচন্ড লড়াই। মর্মস্পর্শী তাকবীর ধব্বনিতে মূখরিত হয় আকাশ বাতাস। দীর্ঘ জিহাদের পর খৃস্টান বাহিনি পর্যদস্ত হয়। একের পর এক স্পেনের সকল শহর করায়ত্ব হয় মুসলমানদের। সলিল সমাধি হয় জালিম শাসকের।
তারপর থেকে ১৪৯২ সাল পযর্ন্ত প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানেরা শান্তি আর সাম্য বজায় রেখে স্পেন শাসন করে। এ দীর্ঘ আটশত বছরে মুসলমানেরা স্পেনের বর্বর চেহারা সম্পূর্ণ সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত করে। তাদের ন্যায়-ইনসাফ আর ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে আশ্রয় নেয় ইসলামের ছায়া তলে। শিক্ষা-সাংস্কৃতি ,জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-বাণিজ্যে ইত্যাদির কেন্দ্র-বিন্দুতে পরিণিত হয় স্পেন। কালের প্রবাহে এক সময় মূসলমানেরা কুরআন- সুন্নাহ, শিক্ষা-সাংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ছেড়ে আরাম-আয়েশে মত্ত হতে শুরু করল। শাসকদের মাঝে অর্থের লোভ, ভোগ- বিলাসিতা ও বিজাতিয় আচার-আচরনসহ সব ধরনের নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়। মুসলিম শাসকদের মধ্যে অনৈক্য ও বিবাদ শুরু হয়। ধীরে ধীরে মুসলিম শাসকরা ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ফলে মুসলিম রাজ্যগুলো ধীরে ধীরে মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে খ্রীস্টানদের দখলে যেতে থাকে। মুসলিম সাম্রাজ্যে নেমে আসে পরাজয়ের কালোছায়া। এরই ধারাবাহিকতায় আসে স্পেনের পালা। এক পর্যায়ে মুসলিম নিধনের লক্ষ্যে খ্রীস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড বিয়ে করে পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলাকে। যার ফলে মুসলিম বিরোধী দুই বৃহৎ খ্রীস্টান শক্তি সম্মিলিত শক্তি রুপে আত্মপ্রকাশ করে। রাণী ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিন্যান্ড খুঁজতে থাকে স্পেন দখলের মোক্ষম সুযোগ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগায় খৃস্টান শক্তি ।
যখনই মুসলমানেরা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ভূলে আরাম আয়েশে লিপ্ত হল এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ শুরু হল তখনই তাদের উপর নেমে আসলো এক অমানিবক অত্যাচার এবং হত্যাযজ্ঞ। ইউরোপের মাটি থেকে মুসলমানদের চিরতরে বিলীন করার জন্য মেতে উঠে ইউরোপিয় নরপিচাশেরা।
১৪৯২ খৃ. মুসলিম শাসন ও সভ্যতার গৌরবোজ্জল জনপদ স্পেনে পর্তুগিজ রাণী ইসাবেলা এবং পার্শ্ববর্তী রাজা ফার্ডিন্যান্ডের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী ১লা এপ্রিল চতুরদিক থেকে মুসলমানদেরকে ঘেরাও করে পশুর মত ঝাপিয়ে পড়ে। অসংখ্য নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। এ সময় ফার্ডিন্যান্ডের নির্দেশে আশপাশের সব শস্য খামার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়- শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ‘ভেগা উপত্যকা’। অচিরেই গোটা শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষ যখন প্রবল আকার ধারণ করে তখন প্রতারক ফার্ডিন্যান্ড ঘোষণা করলো, ‘মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে তাহলে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে।’
এমতাবস্থায় নেতৃত্বহীন নিরীহ অপ্রস্তুত মুসলমানেরা বুকভরা আশায় নিয়ে রাজধানী গ্রানাডায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছুই মিলেনা। কারণ, যারা তাদের নেতৃত্ব দিবে, তাদের ঈমান আমল আগেই বিলীন হয়ে গেছে। মুসলমান রাজা-বাদশারা ছিল বহুদলে বিভক্ত ।
খৃস্টানরা গ্রনাডা দখল করে মুসলমানদের উপর চালালো অত্যাচারের স্টীমরোলার। প্রাণ বাঁচাতে মুসলমানরা দিশেহারা হয়ে যখন অবস্থা প্রকট রুপ ধারন করল, তখন ধূর্তবাজ রজা ফার্ডিন্যান্ডে ঘোষনা দেয়, যে মুসলমানেরা অস্ত্র সমর্পণ পূর্বক মসজিদ সমূহে আশ্রয় নিবে তাদেরকে পূর্ণ নিরাপাত্তা দেওয়া হবে এবং যারা সমূদ্রের জাহাজ সমূহে আশ্রয় নিবেে, তাদেরকে অন্যান্য মুসলিম দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। নেতৃত্বহীন অসহায় মুসলমানেরা অস্ত্রবিহীন ক্ষুধা-পিপাসা কাতর হয়ে অর্ধৈয্য হয়ে পড়েছিল। তারা নরপিচাশ খৃস্টানদের প্রতারণা না বুঝে সরলমনে মসজিদ এবং জাহাজ সমূহে আশ্রয় নেয় ।
তখনই জালিম, নরপিচাশ প্রতারক রাজা ফর্ডিন্যান্ডের নির্দেশে খৃষ্টান সৈন্যরা মসজিদ সমূহে তালাবদ্ধ করে দিয়ে ভিতরে ও বাহিরে চতুরদিক আগুন লাগিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ মুসলমানদেরকে পুড়িয়ে নির্মমভাবে শহীদ করে এবং জাহাজগুলোতে আশ্রিত মুসলমানদেরকে গহীন সমূদ্রে ডুবিয়ে মারে। ত্রিশ লক্ষ মুসলমানকে পুড়িয়ে মারলো এক সাথে। এভাবে আগুনে পুড়ে ভস্মিভূত হল আধুনিক ইউরোপের জনকেরা। পরবর্তীতে মুসলমানদের মসজিদ-মাদ্রাসা এবং স্মৃতিগুলোকে বানিয়ে ছিল তাদের ঘোড়ার আস্তাবল।
অসহায় নারী-পুরুষ আর শিশুদের আর্তচিৎকারে ঐদিন আকাশ- বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। মুসলমানদের দুর্দশা দেখে জালিম , নরপিচাশ প্রতারক রাজা ফর্ডিন্যান্ড তার স্ত্রী ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ উল্লাসে বলে উঠে, হায় মুমলমান ! তোমরা কত বোকা।
সে দিনটি ছিল এপ্রিল মাসের ০১ তারিখ। সেই থেকেই মুসলমানদেরকে উপহাস করার জন্য খৃষ্টানরা প্রতি বছর ১লা এপ্রিলকে অত্যন্ত জাকজমকের সাথে ‘এপ্রিল ফুল’ বা এপ্রিলের বোকা দিন হিসেবে উৎসবের পালন করে আসছে। নাউজুবিল্লাহ।
শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি খৃষ্টান নরপিচাশ ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলা। তারপরেও যেসব মুসলমান বেঁচে ছিল তাদেরকে জোর করে খৃষ্টান বানানো হয়। মসজিদগুলোকে গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়। বুযদিল শাসক বুআবদিল্লাহ ন্যাক্কারজনক ভাবে দাসচুক্তিতে স্বাক্ষর করে পার পেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তিনিও রেহাই পাননি। খৃষ্টান ঐতিহাসিকদের লিখিত ইতিহাসে লেখা আছে, বুআবদিল্লাহর আত্মসমর্পনের দিনটি ছিল ১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারি। সেই হিসেবে ১লা এপ্রিলের মুসলিম হত্যাযজ্ঞের নির্মম ঘটনাটি মেলে না। আর এটা নিয়ে নাস্তিক ব্লগাররা মুসলমানদের করুণ ইতিহাসকে ‘মিথ্যার বেসাতি’ বলে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার যে এপ্রিলকেই জানুয়ারি হিসেব করে সে কথাটি বেমালুম চেপে যান। ক্যালেন্ডার বদলের সাথে এপ্রিলের ফুলসের যে থিমটি বর্তমানে আধুনিক খৃষ্ট বিশ্বে চালু আছে- তাও এটার সাথে মিলে যায়।
১৯৯৩ সালের পহেলা এপ্রিল গ্রানাডা ট্যাজেডির পাঁচশ বছর উদযাপন উপলক্ষে স্পেনে আড়ম্বরপূর্ণ এক সভায় মিলিত হয়েছিল বিশ্ব খৃস্টান সম্প্রদায়। সেখানে তারা নতুন করে শপথ নেয়- একচ্ছত্র খৃস্টবিশ্ব প্রতিষ্ঠার। বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণ ঠেকাতে গড়ে তোলে ‘হলি মেরি ফান্ড’। এরই ধারাবাহিকতায় গোটা খৃস্টবিশ্ব নানা অজুহাতে ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, ইয়েমেন তথা মধ্যপ্রআচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশসহ সারা পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। কখনো তারা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, আবার কখনো মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। প্রায় সকল মুসলিম দেশেই চলছে দুঃসাশন, অত্যাচার-অবিচার, হত্যাযজ্ঞ এবং জঙ্গীবাদ। এসবের মূলে কিন্তু তারাই রয়েছে। এক মুসলমানকে দিয়েই আরেক মুসলমানকে নির্যাতন করেছে। অতএব, সামনে ভয়াবহ দুর্দিন। এই দুর্দিনে এসব নব্য ফার্ডিন্যান্ড-ইসাবেলাদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী শক্তির চাই- সুদৃঢ় ঐক্য এবং জাগরণ। আর যদি তা করতে ব্যর্থ হই, তবে অচিরেই গ্রানাডার মতো বধ্যভূমিতে পরিণত হবে পুরো মুসলিম বিশ্ব। সুতরাং বেশি বেশি ভাবুন, কাঁদুন এবং জাগরিত হোন। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরুন। বিভেদ নয়, ঐক্যের পথ খুঁজুন এবং নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখুন।
- লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক