একজন এসিল্যান্ডের দাপট; ক্ষমতার অপব্যবহার করায় প্রত্যাহার

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে যশোরের মণিরামপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানের নেতৃত্বে ২৭ মার্চ শুক্রবার বিকেল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন প্রথমে দুই বৃদ্ধ। এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তাদের মুখে মাস্ক ছিলনা। এ সময় পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে সাইয়েমা হাসান শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এছাড়া পরবর্তীতে অপর এক ভ্যানচলককে অনুরূপভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন।

শুক্রবার রাতে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সবাই।

  • Save

এ প্রসঙ্গে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, ‘ছবিটি আমি দেখেছি। এটি তিনি করতে পারেন না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমাদের কাজ নয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে জানতে শুক্রবার রাত ১১টার পর কয়েকবার ফোন করলেও মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসানের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। শনিবার সকালেও তার ফোন বন্ধ রয়েছে । তবে সমালোচনা শুরু হলে তিনি মনিরামপুরের সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনে ভুল হতে পারে। ঘটনাটি নিয়ে তিনি বিব্রত। ভুল হয়ে থাকলে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবিটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউজে) সভাপতি সাজেদ রহমান ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করে লিখেছেন, রাষ্ট্রের মালিকের সাথে, রাষ্ট্রের কর্মচারীর আচরণ…কান ধরে ওঠবস করানো বৃদ্ধটি ভ্যানচালক। নাম বললাম না। পেটের দায়ে সংসারের চাল-ডাল কিনতে এসেছিলেন যশোরের মণিরামপুরের চিনাটোলা বাজারে। উপজেলার এসিল্যান্ড সাইমা হাসান জনসম্মুখে তাকে কান ধরে ওঠবস করালেন। আবার মজার ঘটনা মনে করে তিনি ছবি তুললেন নিজের মোবাইলে। এসিল্যান্ড দেশের সামান্য একজন কর্মচারী। এই ছবি দেখে আমি স্থির থাকতে পারছি না। আমি তার শাস্তি দাবি করছি।

সাজেদ রহমানের পোস্টটি শেয়ার করেছেন যশোর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু। তিনি লিখেছেন, ‘সরকার ও প্রশাসনের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে অতিউৎসাহী কিছু পুলিশ ও আমলা। এইসব বন্ধ করুন।’

অপর একজন সাংবাদিক লিখেছেন, এই ক্যাডারের জন্য আমার সুনির্দিষ্ট একটা প্রস্তাব থাকলো। আমার জানামতে, কান ধরে উঠবস করানো সম্পূর্ণ বেআইনী, অসাংবিধানিক, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কান ধরে উঠবস করানোর মতো অমর্যাদাকর দন্ড প্রদান নিষিদ্ধ। কোনো অজুহাতেই মানুষকে এমন অমর্যাদাকর, লাঞ্ছনাকর দন্ড প্রদান করার এখতিয়ার কারোরই নেই, এমনকি সাক্ষ্যপ্রমাণে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কোনো বিচারিক আদালতেরও নেই। জরুরী অবস্থানকালীন সময়েও সংবিধানের এই মৌলিক অনুচ্ছেদটি শিথিলযোগ্য নয়। বাবা, দাদার বয়সী লোকদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা এবং তা নিজের মোবাইলে ভিডিও বা ছবি ধারণ করা। গর্হিত ও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আমরা প্রত্যাশা করবো- শুধু প্রত্যাহার নয়, এই বজ্জাতি নারী প্রকাশ্যে জনসম্মুখে এই বয়স্ক লোকদের কাছে ক্ষমা চাইবে এবং জনসাধারণ তার ভিডিও ধারণ করবে। সেই সময় তার বাবা মা ও পরিবারের সকলে সেখানে উপস্থিত থাকবে।

যশোর মনিরামপুরে সহকারী কমিশনার (ভুমি) সাইয়েমা হাসান সাধারন মানুষের মুখে মাস্ক না থাকায় কান ধরে উঠবস করাচ্ছেন। কিন্তু কোন অপরাধের জন্য, কোন আইনের বলে? যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসে সুস্থ ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই বলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েই জানিয়েছেন ।

সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার

এদিকে মাস্ক না পড়ার কারণে বয়স্ক লোকদের কান ধরে ওঠবস করানো যশোরের মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। শনিবার সকালে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার জন্য আমার দুঃখ প্রকাশ করছি।’

এই ঘটনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, ‘আমরা ওই কর্মকর্তাকে (সাইয়েমা হাসান) প্রত্যাহার করে বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে সংযুক্ত করার জন্য বলেছি। সেটা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যে তিনজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়েছে মণিরামপুরের ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) মিডিয়াকে নিয়ে তাদের বাড়ি যাচ্ছেন, এবং তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করবেন। তাদের যদি খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন হয় সেটা দেবেন। এসিল্যান্ডকে সেখানে নেয়া হবে না, যেহেতু আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে সরি বলবেন।’

‘আপাতত তাকে (এসিল্যান্ড) প্রত্যাহার করে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে।’ শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘আমরা খুবই দুঃখিত। যা ঘটেছে তাতে তার (সাইয়েমা হাসান) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তার পক্ষে আমাদের সরি বলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাদের আচরণের জন্য আমাদের বিব্রত হতে হয়। এই ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি।’