হোম বাংলাদেশ খালি হবে কীভাবে এমপি আনারের আসন?

খালি হবে কীভাবে এমপি আনারের আসন?

আগামী ৫ জুন অনুষ্ঠেয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের আগেই বিষয়টির সুরাহা হবে বলে সংবাদমাধ্যমের কাছে আশা প্রকাশ করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

 সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ‘হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে দুই দেশেই তোলপাড় চলছে। এখন পর্যন্ত তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। তবে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই বলছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন, ঝিনাইদহের ওই সংসদ সদস্য যে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

এমপি আনার ‘খুন’ হয়েছেন, তবে তার মরদেহ উদ্ধার না হওয়ায় সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
তবে আনারের মরদেহ পাওয়া না গেলে, তার সংসদীয় আসন ঝিনাইদহ-৪ কীভাবে শূন্য ঘোষণা করা হবে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে এরআগে কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
 আগামী ৫ জুন অনুষ্ঠেয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের আগেই বিষয়টির সুরাহা হবে বলে সংবাদমাধ্যমের কাছে আশা প্রকাশ করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।  মৃত্যু, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে সংসদের কোনো আসন শূন্য হলে সংসদ সচিবালয় থেকে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সেই আসন মৃত্যুর তারিখ থেকে শূন্য ঘোষণা করা হয়। পরে গেজেটের কপি পাঠানো হয় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে।
 তবে আনারের ‘মৃত্যু’ সেরকম সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। অতীতে কোনো সংসদ সদস্য মারা গেলে বা হত্যার শিকার হলে তার প্রমাণ নিয়ে সমস্যা হয়নি। কারণ তাদের মরদেহ পাওয়া গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে দাফন-সৎকারও হয়েছে। তবে আনার ভারতে ‘খুন’ হয়েছেন বলা হলেও, তার মরদেহ না মেলায় প্রমাণের প্রশ্নটি আসছে।

যেভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে

কলকাতায় যেখানে আনার নিহত হয়েছেন, সেখান থেকে মৃত্যুসনদ পেলেই এই জটিলতার সুরাহা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া বলেন, ‘এটি একটি নজিরবিহীন সমস্যা। সংসদ সচিবালয় কিংবা নির্বাচন কমিশন আগে কখনও এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়নি।’
‘আর কোনও না কোনও সূত্র থেকে সংসদের কাছে নিশ্চিত একটি খবর আসতে হবে যে, তিনি মারা গেছেন বা নিহত হয়েছেন। এখন সেই সূত্র কী হবে? তার যে জুরিসডিকশন, যে লোকাল এরিয়া, যেখানে ঘটনা ঘটেছে বলে এরইমধ্যেই সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে, সেটা হচ্ছে কলকাতা’, যোগ করেন তিনি।
 প্রশান্ত ভূষণের মতে, ‘তার মৃত্যুসনদ যদি সংসদ সচিবালয় না পায়, তাহলে তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করা যাবে না। অর্থাৎ আসন শূন্য ঘোষণা করার আগে তার মৃত্যু নিশ্চিত হতে হবে।’
 এই আইনজীবীর মতে, ‘তার আগে আরেকটি ঘটনা ঘটবে, সেটা হলো- ফরেনসিক প্রতিবেদন পেতে হবে। তার মেয়ের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে সেপটিক ট্যাংকে যে দেহাংশ পাওয়া গেছে, সেটার সঙ্গে মেলাতে হবে। যদি মিলে যায়, তাহলে কলকাতা থেকে মৃত্যু সনদ ইস্যু করা হবে।’
 এছাড়া তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করার আইনগত কোনো উপায় নেই বলে জানান প্রশান্ত ভূষণ। ‘কারণ সংসদকে জানতে হবে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু সংসদকে কে জানাবে? যারা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তারা, না। কারণ আজ স্বীকারোক্তি দিয়েছে, কাল আদালতে গিয়ে সেটা প্রত্যাহার করার আবেদন দিতে পারেন অভিযুক্তরা’, বলেন এ আইনজীবী।
 তিনি বলেন, ‘কাজেই একমাত্র উপায় হচ্ছে, ফরেনসিক প্রতিবেদনে যদি ডিএনএ নমুনায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই দেহাংশ নিখোঁজ সংসদ সদস্যের। তখন সংসদ সচিবালয় সেটা নির্বাচন কমিশনে পাঠাবে যে আসনটি শূন্য ঘোষণা করা যায়। পরে সে অনুসারে নির্বাচন কমিশন ষাট দিনের মধ্যে নির্বাচনটি করবে। এটাই হচ্ছে এই মুহূর্তের আইনগত অবস্থা।’

সংবিধান যা বলছে

সংবিধানের প্রথম পরিচ্ছেদের ৬৭ ধারার এক উপধারায় বলা হয়েছে, ‘৬৭। (১) কোনো সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি (ক) তাহার নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে নব্বই দিনের মধ্যে তিনি তৃতীয় তফসিলে নির্ধারিত শপথগ্রহণ বা ঘোষণা করিতে ও শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিতে অসমর্থ হন।’
 ‘তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পূর্বে স্পিকার যথার্থ কারণে তাহা বর্ধিত করিতে পারিবেন।’
 ‘এছাড়া (খ) সংসদের অনুমতি না লইয়া তিনি একাধিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকেন; (গ) সংসদ ভাঙ্গিয়া যায়। (ঘ) তিনি এই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন অযোগ্য হইয়া যান; অথবা (ঙ) এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।’
 ‘(২) কোন সংসদ-সদস্য স্পিকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন এবং স্পিকার- কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকিলে বা অন্য কোনো কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ডেপুটি স্পিকার- যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।
যেভাবে আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়
অনুমতি ছাড়া ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে সংবিধান অনুসারে ওই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি গেজেট প্রকাশ করে সংসদ সচিবালয় তা নির্বাচন কমিশনকে জানায়।
 নির্বাচন কমিশনের ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পর দ্রুতই সেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্পিকার শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। এছাড়া অধিবেশন চলাকালে কেউ মারা গেলে ওই দিনের জন্য সংসদ অধিবেশন মুলতবি করার রেওয়াজও রয়েছে।
 তবে, এখন পর্যন্ত যে সংসদ সদস্যরা মারা গেছেন, কারো ক্ষেত্রেই মরদেহ না পাওয়া সংক্রান্ত জটিলতা ছিল না, যেটি ঘটেছে আনারের ক্ষেত্রে।
 এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, যেদিন থেকে তার মৃত্যু নিশ্চিত হবে, সেদিন থেকে সংবিধান এবং কার্যপ্রণালী অনুযায়ী ওই আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। অন্যান্য সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করলে যেটা হয় সেটাই হবে।
 গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ১৩ মে রাতে খুন করা হয় এমপি আনারকে। হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশের দিনই (২২ মে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন।

আনারের মরদেহ নিয়ে যা বললেন ডিবির হারুন

কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি চালিয়ে আনারের শরীরের কিছু অংশ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
 আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ২৬ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যায় ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের একটি প্রতিনিধি দল। ঢাকায় ফিরে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, কলকাতায় যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সংসদ সদস্যের দেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধার করা। এ কারণে তারা সেখানকার পুলিশকে সেপটিক ট্যাংক ও পয়োনিষ্কাশন নালা দেখার অনুরোধ করেন। পরে সেখানে ভুক্তভোগীর শরীরের কিছু অংশ পাওয়া গেছে। সেগুলোর ডিএনএ টেস্ট করার পর কলকাতা পুলিশ চূড়ান্তভাবে জানাবে।
 স্বাভাবিকভাবেই সেখানে খণ্ডিত দেহাংশ থাকার কথা নয় উল্লেখ করে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এ কারণেই আমরা  মনে করেছি, এগুলো আনারেরই হবে। কলকাতা পুলিশ খুব দ্রুত ডিএনএ পরীক্ষার ফল জানাবে।’
 এর আগে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম (লিটন) নিজ বাড়িতে খুন হন। তারও আগে আহ্সান উল্লাহ্ মাস্টার সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় খুন হন। তবে তাদের মরদেহ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল না। মৃত্যুর পরপরই সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করে।